লেখকঃ মোঃ নাজমুল ইসলাম (সাংবাদিক ও কলামিস্ট)
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে সাংবাদিকতা পেশা দেশের গণতন্ত্র, ন্যায় বিচার ও জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা পালন করে আসলেও, এই পেশার সাথে যুক্ত সাংবাদিকদের জীবনের ঝুঁকি ও ভীতি কখনো কমেনি; বরং সময়ের সাথে বাড়তে থাকায় সাংবাদিকেরা হত্যা, নির্যাতন, হয়রানি ও নির্বাসনের শিকার হচ্ছেন যা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বহু বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক নিহত হন এবং স্বাধীনতার পর থেকে অন্তত ত্রিশের বেশি সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে প্রাণ হারিয়েছেন, যেমন মানিক চন্দ্র সাহা, গৌতম দাস, হুমায়ুন কবীর বালু, রফিকুল ইসলাম ও ওহিদুজ্জামানের মতো বিশিষ্ট সাংবাদিকেরা; ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির নির্মম হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজের জন্য একটি তীব্র ট্রমা হয়ে দাঁড়ায়, যেখানে বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘ বিলম্ব ও চার্জশিট না হওয়া বিচারহীনতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়; এ ছাড়াও ২০২৫ সালের ৭ আগস্ট গাজীপুরে দৈনিক প্রতিদিনের সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে স্থানীয় চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি উন্মোচনের কারণে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যা দেশের সাংবাদিক সমাজে ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা চেতনার ঘোর অভাব প্রকাশ করে; এসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল আইনি কাঠামো, নিরাপত্তা বাহিনীর জবাবদিহিতার অভাব এবং সাংবাদিকদের জন্য কার্যকর সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকার বাস্তবতা; এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে সাংবাদিকরা বিভিন্ন সময়ে মিথ্যা মামলা, শারীরিক হামলা ও সামাজিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন, ফলে অনেকেই প্রাণ ও পরিবারের নিরাপত্তার জন্য দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন, যেমন কানক সরওয়ার, তাসনিম খলিলসহ অসংখ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিক নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন; আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে সাংবাদিক হত্যার প্রায় ৯০% মামলা এখনও বিচারহীন, এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি; সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতন শুধুমাত্র সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, এটি সমাজের তথ্যপ্রবাহ ও গণতন্ত্রের জন্যও বড় হুমকি, কারণ নিরাপত্তাহীনতার কারনে অনেক সময় সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকেন, যা দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবেদনগুলো জনগণের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে, ফলে জনমত বিভ্রান্ত ও দুর্বল হয়; এই সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্রুত ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, নির্বাসিত সাংবাদিকদের আর্থিক ও আইনগত সহায়তা, মাঠ পর্যায়ের নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি; রাষ্ট্র ও সমাজকে একযোগে কাজ করে সাংবাদিকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সত্য প্রকাশে তাদের সাহস ও উৎসাহ বৃদ্ধি পায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম স্বাধীন গণমাধ্যমের আলোয় বিকশিত হয়, কারণ সত্যকে দমন করা যায় না যতক্ষণ সাহসী কিছু কণ্ঠস্বর দাঁড়িয়ে থাকে; সাগর-রুনি থেকে তুহিন পর্যন্ত এই ধারাবাহিক শোকগাথা আমাদের শেখায় যে, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচার টিকিয়ে রাখতে সাংবাদিকদের জীবন ও স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সুরক্ষা প্রদান অপরিহার্য।