একজন মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠেন কীভাবে? কেবল জন্মসূত্রে মানুষ হওয়াই কি যথেষ্ট, নাকি তাকে মানুষ হয়ে উঠতে হয় সাধনা, চিন্তা, মনন ও কর্মের মধ্য দিয়ে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে তাকাতে হয় সভ্যতার ঊষালগ্নে, যখন মানবজাতি সমাজবদ্ধ জীবন শুরু করে এবং জ্ঞান, নৈতিকতা ও রুচির চর্চার মাধ্যমে এক উন্নততর স্তরে পৌঁছায়। এই উত্তরণের পথে তিনটি জ্ঞানক্ষেত্র—ধর্ম, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি—বহু শতাব্দী ধরে মানবসভ্যতাকে গড়ে তুলেছে এবং গঠন করেছে প্রকৃত মানুষের রূপ।
ধর্ম: আত্মোপলব্ধির শিক্ষা
ধর্ম মানবজাতির নৈতিক ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মানবসভ্যতার প্রাচীনতম দলিলগুলোতে ধর্মের উপস্থিতি স্পষ্ট। হোক তা সুমেরীয় সভ্যতার মেসোপটেমিয়া, প্রাচীন ভারত, মিশর কিংবা চীন—সর্বত্র ধর্ম ছিল সমাজগঠনের ভিত্তি। ধর্ম মানুষকে শিক্ষা দেয় আত্মজ্ঞান, আত্মসংযম ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। ইসলাম, হিন্দুধর্ম, খ্রিস্টধর্ম, বৌদ্ধধর্ম—প্রতিটি ধর্মেই রয়েছে মানুষের উন্নত চরিত্র গঠনের দিকনির্দেশনা।
ধর্মের বিশ্বাস মানুষকে লোভ, হিংসা, বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে ওঠার আহ্বান জানায়। তবে ধর্ম যদি কুসংস্কার, সংকীর্ণতা বা সহিংসতার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তা প্রকৃত মানুষ গঠনের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে। তাই ধর্মচর্চা হতে হবে যুক্তিনির্ভর, সহনশীল এবং মানবিকতায় পূর্ণ। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, *“নিজের আলো নিজের মধ্যে খোঁজো”—*এই স্বশিক্ষার কথাই সত্যিকার ধর্মচর্চার লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বিজ্ঞান: যুক্তিবোধ ও বাস্তবতার অন্বেষণ
বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে চিন্তা করার পদ্ধতি, বিশ্লেষণের দক্ষতা ও যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন কিংবা বাংলাদেশের স্যার জগদীশচন্দ্র বসু—সবাই বিজ্ঞানের আলোয় দেখেছেন প্রকৃতির অন্তর্নিহিত নিয়ম।
একজন প্রকৃত মানুষ হতে হলে তাকে হতে হবে বাস্তবতাবোধে সুসজ্জিত। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস কিংবা অযৌক্তিক ধারণার বিপরীতে তার অবস্থান হবে দৃঢ়। বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে সে যেমন পৃথিবীকে বুঝবে, তেমনি নিজেকেও জানবে। দার্শনিক ডেকার্তের সেই ঐতিহাসিক বাক্য—Cogito, ergo sum (আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি)—বিজ্ঞানের আত্মবিশ্বাসের অন্যতম ভিত্তি।
তবে বিজ্ঞানচর্চা হতে হবে নৈতিকতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে। প্রযুক্তির অপব্যবহার, পরিবেশ ধ্বংস কিংবা মানবিক বোধহীন গবেষণা যেমন ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনে, তেমনি মানুষের প্রকৃত সত্তাকেও নষ্ট করে দেয়। তাই বিজ্ঞান ও নৈতিকতা—এই দুটি যেন সমান্তরাল পথে চলে।
সংস্কৃতি: হৃদয়ের গভীরে রুচি ও মূল্যবোধের বীজ
সংস্কৃতি মানুষের আত্মার প্রতিচ্ছবি। তার ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস—সবকিছু মিলিয়ে গড়ে ওঠে একটি জাতির সংস্কৃতি। সংস্কৃতি মানুষের মননশীলতা, সৌন্দর্যবোধ, সহনশীলতা ও সৃজনশীলতাকে বিকশিত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “সংস্কৃতি যদি সত্য হয়, তবে সে ব্যক্তিস্বাধীনতার মধ্যে দিয়াই আপনাকে প্রকাশ করে।”
সংস্কৃতি মানুষকে শেখায় ভিন্নতার প্রতি সহনশীলতা। একসঙ্গে বসে গান গাওয়া, নাটক দেখা কিংবা উৎসব উদ্যাপন মানুষকে করে সংবেদনশীল, মানবিক ও সম্প্রতির পৃষ্ঠপোষক। জাতীয় সংস্কৃতি যেমন আমাদের পরিচয়ের ভিত্তি, তেমনি আন্তঃজাতিক সংস্কৃতিচর্চা আমাদের করে বিশ্বনাগরিক।
তবে অন্ধ অনুকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ এবং লোকজ সংস্কৃতির অবমূল্যায়ন আমাদের সমাজে যখন প্রবেশ করে, তখন মানুষ হারিয়ে ফেলে তার শিকড়। প্রকৃত মানুষ গড়তে চাইলে চাই সমন্বয়—আধুনিকতার সঙ্গে শেকড়ের বন্ধন বজায় রাখা।
সমন্বয়ের দর্শন: ত্রিবিধ জ্ঞানচর্চার সেতুবন্ধন
ধর্ম, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি—এই তিনটি ক্ষেত্র একে অপরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং পরিপূরক। ধর্ম মানুষকে দেয় নৈতিকতার ভিত্তি, বিজ্ঞান দেয় যুক্তির আলো আর সংস্কৃতি গড়ে তোলে হৃদয়ের বিস্তার। এই তিনটি চর্চা যখন সমন্বিতভাবে চলে, তখনই গড়ে ওঠে এমন মানুষ, যিনি কেবল শিক্ষিতই নন, বরং মানবিক, বিবেকবান ও মননশীল।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই তিনটি ক্ষেত্রেই দরকার নতুন করে ভাবনা। ধর্মীয় সহনশীলতা, বিজ্ঞানশিক্ষার বাস্তবায়ন এবং লোকজ সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন—এই তিনটি পদক্ষেপ আমাদের সমাজকে এগিয়ে নিতে পারে এক মানবিক উন্নয়নের পথে।
আমাদের শিক্ষানীতিতে, সামাজিক উদ্যোগে ও পারিবারিক পরিবেশে এই ত্রিত্বের জ্ঞানচর্চার সুযোগ তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। কারণ, প্রকৃত মানুষ তৈরি না হলে উন্নয়ন হবে একরৈখিক, খণ্ডিত ও আত্মবিচ্যুত।
মানুষ গড়ার শিল্প সবচেয়ে জটিল, সবচেয়ে জরুরি। অর্থ, ক্ষমতা কিংবা প্রযুক্তি দিয়ে তা অর্জন করা যায় না। ধর্মের নৈতিক শিক্ষা, বিজ্ঞানের যুক্তিবোধ এবং সংস্কৃতির মানবিক সৌন্দর্য—এই তিনের সমন্বয়ে গড়তে হবে সেই মানুষ, যে নিজের কাছে দায়বদ্ধ, সমাজে দায়িত্বশীল এবং বিশ্বে দায়িত্ববান। এভাবেই আমরা পাবো প্রকৃত মানুষ, আর সে মানুষই গড়ে তুলবে একটি উন্নততর সমাজ, এক মানবিক বিশ্ব।
লেখকঃ মোঃ নাজমুল ইসলাম (সাংবাদিক ও কলামিস্ট)
