নেত্রকোনা—একটি নদী, পাহাড় ও হাওরবেষ্টিত সমৃদ্ধ জনপদ। জেলার প্রশাসনিক সদর নেত্রকোনা শহর, যেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষের পদচারণা। চিকিৎসা, শিক্ষা, প্রশাসনিক কার্যক্রম, বাণিজ্য কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড—সবই এই শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে আবর্তিত হয়। কিন্তু গত এক দশকে এই শহরের মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ ও নাগরিকবান্ধব সমস্যার নাম হয়ে উঠেছে—যানজট। আর এই যানজট এখন নিত্যদিনের বাস্তবতা, নাগরিক জীবনযাত্রার বাধা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির প্রতিবন্ধক।
একসময়ের ছিমছাম ও শান্ত শহরটি আজ ব্যস্ততায় বিপর্যস্ত। শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সাতপাই কেডিসি রোড, মোক্তারপাড়া, কোর্ট রোড, বড় বাজার ও ছোট বাজার, সদর হাসপাতালের সামনের সড়কগুলোতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যানজটে নাকাল হয় মানুষ। কোথাও কোথাও দশ মিনিটের পথ অতিক্রম করতে লাগে ঘণ্টারও বেশি সময়। এই অবস্থা শুধু নাগরিক ভোগান্তির গল্প নয়—এ এক ‘নগর সংকট’।
নেত্রকোনার যানজট সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ হলো ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার অনিয়ন্ত্রিত সংখ্যা। শহরের ভেতর প্রতিদিন কমবেশি ৮ হাজারের বেশি অটো চলে, যার অধিকাংশই অনিবন্ধিত ও লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে। এদের কেউ স্কুলপড়ুয়া কিশোর, কেউ অদক্ষ যুবক। ট্রাফিক নিয়ম, সড়ক শৃঙ্খলা কিংবা যাত্রী নিরাপত্তা—কোনো কিছুই এদের চিন্তার বিষয় নয়।
প্রতিটি মোড়ে মোড়ে দেখা যায় একাধিক অটো দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছে, যত্রতত্র থামছে, হঠাৎ রাস্তায় বাঁক নিচ্ছে। এমনকি ফুটপাত, স্কুলের গেট কিংবা হাসপাতালের প্রবেশদ্বারেও এরা নির্বিচারে যানবাহন দাঁড় করিয়ে রাখে। শহরের প্রবেশপথগুলো যেমন রাজু’র বাজার, বনুয়াপাড়া,মালনীরোড বা সাতপাই থেকে সদরে প্রবেশের পথে অটো ও রিকশার জট স্থায়ী রূপ নিয়েছে।
নেত্রকোনা শহরের সড়ক অবকাঠামো মূলত ঔপনিবেশিক আমলের। অথচ বর্তমানে শহরের ওপর চাপ বেড়েছে বহু গুণ। কিন্তু সেই অনুযায়ী সড়কের কোনো সম্প্রসারণ বা আধুনিকায়ন হয়নি। প্রায় প্রতিটি প্রধান সড়কের প্রস্থ ১৫–২০ ফুট, যেখানে একসাথে তিন ধরনের যানবাহন চলতে গিয়ে নিয়মিত সৃষ্টি হয় যানজট।
বিশেষ করে বড়বাজার, মোক্তারপাড়া , সাতপাই এলাকায় রিকশা-অটো-প্রাইভেটকারের ভিড়ে কখনো কখনো অ্যাম্বুলেন্স বা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও আটকে পড়ে। বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তায় জমে পানি, গর্ত তৈরি হয়—সব মিলে এক জটিল পরিস্থিতি।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার চরম দুর্বলতা
শহরের ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের সংখ্যা অপ্রতুল। যারা আছে, তাদের কার্যক্রম অনেক সময়ই লোকদেখানো। ট্রাফিক লাইট নেই, কোনো ডিজিটাল সিগন্যাল নেই, গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে নেই সিসিটিভি ক্যামেরা। পুলিশ সদস্যরাও প্রাথমিক নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই দায়িত্ব পালন করছেন। ফলে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন যেন এক প্রাত্যহিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুল ছুটির সময় সাতপাই, মোক্তারপাড়া বা শহীদ মিনার এলাকায় একবার গেলেই বোঝা যায় কী ভয়াবহ বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা চলাফেরা করছে।
ফুটপাত দখল ও অবৈধ পার্কিং
ফুটপাত বলতে এখন আর কিছুই নেই নেত্রকোনা শহরে। ছোট বাজার, মোক্তারপাড়া, শহীদ মিনার সাতপাই, —প্রত্যেক এলাকায় হকার আর ভ্রাম্যমাণ দোকানি মিলিয়ে দখল করে রেখেছে পথচারীদের চলার একমাত্র পথ। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে রাস্তায় হাঁটে, আর এতে গাড়ির গতি আরও কমে যায়।
অন্যদিকে বাজার বা অফিস এলাকায় কোনো পার্কিং ব্যবস্থাই নেই। ফলে যানবাহন যত্রতত্র পার্ক করা হয়। শহরে একটি সরকারি বা আধা সরকারি পার্কিং স্পেসও নেই, যা অত্যন্ত আশঙ্কার বিষয়।
যানজটের বহুমাত্রিক ক্ষতি
এই যানজটের প্রভাব কেবল ধীর গতি নয়—এর বহুমাত্রিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত প্রভাব রয়েছে। প্রতিদিন কর্মঘণ্টার বিশাল অংশ নষ্ট হচ্ছে যানজটে বসে থেকে। ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। শিক্ষার্থীরা দেরি করে স্কুলে যাচ্ছে। রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আটকে থাকছে রাস্তায়। অনেক সময় সময়মতো হাসপাতালে না পৌঁছানোর কারণে প্রাণহানিও ঘটছে।
স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে যানজটের কারণে। ধুলাবালি, শব্দদূষণ ও দীর্ঘ সময় রোদে দাঁড়িয়ে থাকার ফলে বাড়ছে হাঁপানি, উচ্চ রক্তচাপ ও মানসিক চাপের সমস্যা। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীদের জন্য এটি আরও ভয়াবহ।
এই সংকটের উত্তরণের সম্ভাব্য উপায়ঃ
নেত্রকোনার যানজট নিরসনে প্রয়োজন সমন্বিত ও বাস্তবমুখী উদ্যোগ। শুধু সড়ক প্রশস্ত করলেই হবে না; প্রতিটি ক্ষেত্রে চাই টেকসই পরিকল্পনা ও আইনের কঠোর প্রয়োগ।
১. ব্যাটারিচালিত অটোর সংখ্যা ও রুট নিয়ন্ত্রণ
পৌরসভার আওতায় প্রতিটি অটোর রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করতে হবে।
চালকদের ট্রাফিক প্রশিক্ষণ ও বয়সসীমা নির্ধারণ করতে হবে।
নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড ও নির্ধারিত সময় অনুযায়ী রুটভিত্তিক চলাচল নিশ্চিত করতে হবে।
২. শহরের প্রধান সড়ক প্রশস্ত ও একমুখী
সাতপাই, মোক্তারপাড়া, কোর্ট রোডসহ প্রধান সড়কগুলো প্রশস্ত করতে হবে।
কিছু এলাকায় একমুখী সড়ক চালু করা যেতে পারে, যেমন ঢাকা ও গাজীপুরে করা হয়েছে।
ভেতরের যানচাপ কমাতে বাইপাস সড়ক নির্মাণ করতে হবে।(যদিও একটি বাইপাস নির্মানাধীন)
৩. আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা
প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ডিজিটাল ট্রাফিক সিগন্যাল ও সিসিটিভি স্থাপন করতে হবে।
ট্রাফিক পুলিশকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে।
নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. নির্ধারিত পার্কিং ও ফুটপাত উদ্ধার
যানজট প্রবণ এলাকায় বহুতল পার্কিং ভবন নির্মাণ করা যেতে পারে।
ফুটপাত দখলমুক্ত করে পথচারীদের চলাচলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
হকারদের পুনর্বাসনের জন্য বিকল্প হাট বা নির্ধারিত দোকান এলাকা নির্ধারণ করা উচিত।
৫. সচেতনতা ও সামাজিক অংশগ্রহণ
স্কুল, কলেজ, মসজিদ ও ক্লাবভিত্তিক ট্রাফিক সচেতনতা কার্যক্রম চালু করতে হবে।
সামাজিক সংগঠন ও ছাত্র সংগঠনগুলোকে যুক্ত করে সপ্তাহব্যাপী সচেতনতা ক্যাম্পেইন চালানো যেতে পারে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে।
নেত্রকোনা শহরের যানজট এখন আর তুচ্ছ কোনো দুর্ভোগ নয়—এটি একটি নীতিগত, অবকাঠামোগত ও প্রশাসনিক সংকট। কিন্তু সংকট যত গভীরই হোক, সমাধান অসম্ভব নয়। নাগরিক সচেতনতা, প্রশাসনিক সদিচ্ছা ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে এই সংকটের অবসান সম্ভব।
আমরা যদি এখনই এগিয়ে না আসি, তবে আমাদের আগামী প্রজন্মকে উপহার দিতে হবে এক থমকে যাওয়া, বিষণ্ন শহর। সে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই কারোই।
লেখকঃ মোঃ নাজমুল ইসলাম (সাংবাদিক ও কলামিস্ট)