বাংলাদেশের বন্দর খাতে বড় ধরনের রূপান্তর আনতে চলেছে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল (এলসিটি) প্রকল্প। এর নির্মাণ, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আগামীকাল সোমবার ৩০ বছরের কনসেশন চুক্তি সই করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) এবং ডেনমার্কভিত্তিক সমন্বিত লজিস্টিকস জায়ান্ট এপিএম টার্মিনালস বিভি। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) আওতায় এই চুক্তি বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনায় এক নতুন যুগের সূচনা করবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অনুষ্ঠেয় চুক্তি সই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ডেনমার্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ট্রেড ও ইনভেস্টমেন্ট বিভাগের স্টেট সেক্রেটারি লিনা গ্যান্ডলোসে হ্যানসেন এবং ঢাকায় ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ব্রিক্স মোলার। সিপিএর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন।
দুটি দশকের অপেক্ষার পর বড় অগ্রগতি
এলসিটি প্রকল্প বহু বছর ধরে পরিকল্পনাধীন থাকলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা জটিলতায় অগ্রগতি ধীর ছিল। অবশেষে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি (সিসিইএ) সিপিএ ও এপিএম টার্মিনালসের মধ্যে কনসেশন চুক্তির নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)’র নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, “এটি বাংলাদেশের বন্দর খাতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। নতুন ব্যবস্থায় সরকারি মূলধনী ব্যয় কমে আসবে, আন্তর্জাতিক মানের দক্ষ অপারেটর যুক্ত হবে—যা এলডিসি-উত্তর বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা বাড়াবে।”
অপারেশন করবে বিশ্বমানের এপিএম টার্মিনালস
বিশ্বব্যাপী ৩৩টি দেশে ৬০টির বেশি টার্মিনাল পরিচালনাকারী এপিএম টার্মিনালস আন্তর্জাতিক বন্দর অপারেটরদের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। বিশ্বব্যাংকের ২০২৪ সালের তালিকায় বিশ্বের সেরা ২০টি বন্দরের মধ্যে ১০টিরই অপারেশন তাদের হাতে।
চুক্তি অনুযায়ী—
- বন্দরটির মালিকানা থাকবে সিপিএর হাতে
- নির্মাণ, ব্যবস্থাপনা ও অপারেশন করবে এপিএম টার্মিনালস ও তাদের স্থানীয় যৌথ অংশীদার
- কেপিআই অর্জনের ওপর ভিত্তি করে অপারেশন চুক্তির মেয়াদ বাড়তে পারে
৫৫০ মিলিয়ন ডলারের ইউরোপীয় বিনিয়োগ
চুক্তির মাধ্যমে এপিএম টার্মিনালস প্রায় ৫৫০ মিলিয়ন ডলার প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) নিয়ে আসছে—যা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বন্দর খাতে সবচেয়ে বড় ইউরোপীয় ইকুইটি বিনিয়োগ। এ বিনিয়োগ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থার নতুন দ্বার খুলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিডা চেয়ারম্যান বলেন, “এপিএম টার্মিনালসের আগমন লজিস্টিকস, শিল্প, কোল্ড চেইন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কসহ বিভিন্ন খাতে আরও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে।”
বছরে ৮ লাখ টিইইউ—বর্তমান সক্ষমতার চেয়েও ৪৪% বেশি
নতুন টার্মিনালের সক্ষমতা বছরে ৮ লাখ টিইইউ। এর ফলে—
- বর্তমান বন্দরের ওপর চাপ কমবে
- দ্রুত বাড়তে থাকা আমদানি-রপ্তানির চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে
- জাহাজের টার্নঅ্যারাউন্ড টাইম কমে যাবে
- অপেক্ষার সময় কমার ফলে লজিস্টিকস ব্যয় হ্রাস পাবে
এলসিটি বর্তমানের তুলনায় দ্বিগুণ আকারের কনটেইনারবাহী জাহাজ গ্রহণ করতে পারবে, যা বৈদেশিক বাণিজ্যের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।
২৪/৭ বন্দর অপারেশন ও রাতের নৌযাত্রা—প্রথমবারের মতো চালু
চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সার্বক্ষণিক (২৪/৭) বন্দর অপারেশন চালু হবে। পাশাপাশি রাতের নৌযাত্রা ব্যবস্থা—যা আগে কার্যকরভাবে চালু হয়নি—নতুনভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। এতে—
- দ্রুত লোডিং-আনলোডিং
- জাহাজের অপেক্ষার সময় কমানো
- সময়মতো পণ্য পরিবহন নিশ্চিত হবে
কর্মসংস্থান ও দক্ষতা বৃদ্ধি
নির্মাণ ও পরিচালনা পর্যায়ে ৫০০–৭০০ সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি পরিবহন, গুদামজাতকরণ, কন্ট্রাক্টিং, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিংসহ বহু খাতে হাজারো পরোক্ষ চাকরি তৈরি হবে।
এপিএম টার্মিনালসের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি স্থানীয় প্রকৌশলী ও কারিগরি কর্মীদের আন্তর্জাতিক-মাপের দক্ষ করে তুলবে। এতে বাংলাদেশের সামগ্রিক লজিস্টিকস খাত নতুন মাত্রা পাবে।
সবুজ বন্দর—জলবায়ু মানদণ্ডের অনুসরণ
এলসিটি একটি সবুজ ও জলবায়ু-সহনশীল বন্দর হিসেবে নির্মিত হবে। এ প্রকল্পে ব্যবহৃত হবে—
- শক্তি-সাশ্রয়ী বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি
- আধুনিক নির্গমন-নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি
- আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও পরিবেশ মানদণ্ড
ফলে কার্বন নিঃসরণ কমবে এবং বাংলাদেশের এনডিসি লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনায় নতুন দিগন্ত
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চুক্তি বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী জটিল পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে দেশ আরও বড় প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের সুযোগ পাবে।
২০২৩০ সালের মধ্যে টার্মিনালটি সম্পূর্ণ চালু হলে বাংলাদেশের লজিস্টিকস খাত নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited