ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতকে জাতীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিতে রূপান্তরিত করতে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে পরপর চারটি বৈঠক করেছে বিনিয়োগ সমন্বয় কমিটি, যেখানে নীতি সংস্কার, উদ্যোক্তা সহায়তা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও রপ্তানি প্রণোদনা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১২টি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
এসব বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী। এতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ. মনসুর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতের শীর্ষ প্রতিনিধিরা।
শনিবার (১ নভেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বার্তায় জানানো হয়, এই বৈঠকগুলোর মূল লক্ষ্য হলো এসএমই উদ্যোক্তাদের সরাসরি নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাদের ব্যবসা পরিচালনা সহজতর করা।
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি
বার্তায় বলা হয়, এ পর্যন্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—
- বৈদেশিক অর্ডার থেকে প্রাপ্ত অর্থের ১০ শতাংশ ব্যাংকে জমা রাখার বাধ্যবাধকতা শিথিলের উদ্যোগ;
- ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে বছরে ন্যূনতম ৩ হাজার মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা কোটা বরাদ্দের প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো;
- এবং উদ্যোক্তাবান্ধব নতুন আর্থিক পণ্য নকশার পদক্ষেপ গ্রহণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকে ৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বৈঠকে আরও চারটি গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে—
১️⃣ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন ও এসএমই বিভাগ যৌথভাবে চলতি মূলধনভিত্তিক নতুন আর্থিক পণ্য নকশা করবে।
২️⃣ বিদ্যমান এসএমই মাস্টার সার্কুলার এর কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা হবে।
৩️⃣ বাণিজ্য লাইসেন্স ছাড়াই পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদানের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করা হবে।
৪️⃣ গ্রাহক পর্যায়ে সুদের হার পুনর্বিবেচনা করে পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচিকে আরও আকর্ষণীয় করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ২৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রথম বৈঠকে এসএমই খাতের নানা চ্যালেঞ্জ—বিশেষ করে অর্থপ্রদানে বিলম্ব, শুল্ক, লাইসেন্স ও ঋণসংক্রান্ত জটিলতা—নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। পরবর্তী বৈঠকগুলোতে এসব সমস্যার সমাধানে বাস্তবসম্মত সুপারিশ তৈরি করে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে পাঠানো হয়।
২১ সেপ্টেম্বর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের সভাকক্ষে আয়োজিত বৈঠকে উদ্যোক্তারা সরাসরি অংশ নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তাব তুলে ধরেন। আর ৮ অক্টোবর অনলাইনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা অংশ নিয়ে তাদের সমস্যার কথা জানান।
বাস্তবায়নাধীন উদ্যোগসমূহ
কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নাধীন—
- নমুনা ছাড়প্রক্রিয়া দ্রুত ও সহজ করা;
- ডিজিটাল মানিব্যাগের মাধ্যমে অর্থপ্রাপ্তিতে আইটি খাতের মতো সুবিধা প্রদান;
- অনলাইন বিক্রির অর্থ দ্রুত উদ্যোক্তার ব্যাংক হিসাবে জমা নিশ্চিত;
- অনলাইন রপ্তানিতে বি-টু-বি ও বি-টু-সি মডেল অন্তর্ভুক্তি;
- এসএমই নীতিমালা প্রচারে সচেতনতামূলক কার্যক্রম;
- উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ বৈদেশিক মুদ্রা/অনুমোদন কার্ড চালু;
- আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের উদ্দেশ্যে প্রতিবেদন প্রকাশে বৈদেশিক বাণিজ্য ইনস্টিটিউটের উদ্যোগ;
- দূতাবাসের মাধ্যমে রপ্তানি সহায়ক কার্যবিধি (এসওপি) বাস্তবায়ন;
- কৃষি ও জৈবপণ্য রপ্তানিতে সনদ ইস্যু সমস্যার সমাধান;
- ব্যাংক গ্যারান্টি ছাড়া আগাম অর্থপ্রদানের সীমা দ্বিগুণ বৃদ্ধি (২০ হাজার ডলার পর্যন্ত);
- ইআরকিউ হিসাব থেকে অর্থপ্রদানের সীমা ৫০ হাজার ডলার নির্ধারণ;
- স্থানীয় বীমা কভারেজসহ উন্মুক্ত হিসাবের মাধ্যমে রপ্তানি লেনদেনের অনুমোদন;
- এবং বাণিজ্যিক অর্থপ্রদানের প্রক্রিয়া সহজভাবে উপস্থাপন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার উদ্যোগ।
সংস্কারের লক্ষ্য: গতিশীল অর্থনীতি
এসব উদ্যোগের সার্বিক লক্ষ্য নিয়ে বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, “এই সংস্কারগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত আমাদের অর্থনীতির প্রাণ, কিন্তু তাদের কণ্ঠ বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো জোরালো নয়। এখন সময় এসেছে তাদের সক্ষমতা ও কণ্ঠ উভয়ই বাড়ানোর।”
তিনি আরও বলেন, “অর্থায়ন থেকে অর্থপ্রদান ও সরবরাহব্যবস্থা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে উদ্যোক্তাদের জন্য প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। সরকারকে এই খাতের সহায়ক হতে হবে, বাধা নয়।”
অর্থনীতিবিদদের মতে, এসব নীতি বাস্তবায়িত হলে এসএমই খাত বাংলাদেশের বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে উঠে আসবে।











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited