বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানি শুরু করেছে। দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক (MoU) এর আওতায় এই আমদানি কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যা দুই দেশের কৃষি ও বাণিজ্য সম্পর্কের নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
রোববার (২৬ অক্টোবর) খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা ইমদাদ ইসলাম স্বাক্ষরিত এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
চুক্তির আওতায় আসছে ৪ লাখ ৪০ হাজার টন গম
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন খাদ্য অধিদপ্তর এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় মোট ৪ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন গম আমদানি করা হবে। এর প্রথম চালান হিসেবে ৫৬ হাজার ৯৫৯ মেট্রিক টন গম বহনকারী ‘এমভি নর্স স্ট্রাইড’ নামের জাহাজটি শনিবার চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃনোঙরে পৌঁছেছে।
গমের চালানটি বর্তমানে কাস্টমস প্রক্রিয়া ও নমুনা পরীক্ষার ধাপে রয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গমের মান পরীক্ষার পর দ্রুত খালাস কার্যক্রম শুরু হবে।
চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে খালাস হবে চালান
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আমদানি করা এই চালানের মধ্যে ৩৪ হাজার ১৭০ মেট্রিক টন গম চট্টগ্রাম বন্দরে এবং অবশিষ্ট ২২ হাজার ৭৮৯ মেট্রিক টন মোংলা বন্দরে খালাস করা হবে। দুই বন্দরে সমান্তরালভাবে গম খালাসের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পরীক্ষার পর গম দ্রুত সংরক্ষণাগারে স্থানান্তর করা হবে এবং সরকারি গুদামে মজুত করে খাদ্য নিরাপত্তা মজুদে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্র: নতুন উৎস, নতুন সম্ভাবনা
বাংলাদেশের গম আমদানির ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত একটি নতুন উৎস দেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববাজারে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সরবরাহ অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ বিকল্প উৎস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নিয়েছে।
বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির এই সিদ্ধান্ত কেবল সরবরাহ বৈচিত্র্য নয়, বরং খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও স্থিতিশীল করবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহফুজুল হক বলেন,
“রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক গম সরবরাহে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানি একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত। এটি ভবিষ্যতের আমদানি ঝুঁকি কমাবে।”
দেশে গমের চাহিদা ও আমদানির চিত্র
বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে ৮০ লাখ মেট্রিক টনের বেশি গমের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে দেশীয় উৎপাদন হয় প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন, বাকি প্রায় ৭০ লাখ টনের বেশি আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের গম আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস হলো রাশিয়া। গত অর্থবছরে মোট আমদানির ৫৪ শতাংশ গম এসেছে রাশিয়া থেকে, এবং ১৪ শতাংশ এসেছে ইউক্রেন থেকে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ভারত থেকেও কিছু পরিমাণ গম আমদানি করা হয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন উৎস দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে যুক্ত করা বাংলাদেশের জন্য আমদানি নির্ভরতার কাঠামোতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
বিশ্ববাজারের পরিস্থিতি ও খাদ্য নিরাপত্তা কৌশল
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে বিশ্ববাজারে গমের সরবরাহ এবং দাম ওঠানামা করছে। একদিকে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে রপ্তানি সীমাবদ্ধতা অনেক দেশে প্রভাব ফেলেছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার গম আমদানির উৎস বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নেয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন,
“আমরা চাই না এক বা দুই দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকতে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আর্জেন্টিনা ও অস্ট্রেলিয়াকে সম্ভাব্য উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।”
তিনি আরও জানান, গম আমদানির পাশাপাশি স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতেও সরকার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কাজ করছে।
‘গমের সরবরাহে স্থিতিশীলতা আসবে’
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানি শুরু হওয়ায় দেশে গম সরবরাহ আরও স্থিতিশীল হবে। এটি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাজারের স্থিতিশীলতাও বজায় রাখবে।”
তিনি জানান, এই চুক্তি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে আগামী বছর আরও বড় পরিসরে আমদানির পরিকল্পনা নেওয়া হবে।
নতুন কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক অধ্যায়
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা কৌশলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির এই উদ্যোগকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি শুধু খাদ্য মজুদে বৈচিত্র্য আনবে না, বরং দুই দেশের সম্পর্ককেও আরও সুদৃঢ় করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
“খাদ্য নিরাপত্তা এখন কেবল কৃষিনীতির বিষয় নয়; এটি পররাষ্ট্র ও বাণিজ্যনীতির অংশ,” বলেন এক বিশ্লেষক।
তিনি যোগ করেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই প্রথম গম বাণিজ্য সেই বহুমাত্রিক সম্পর্কের নতুন সূচনা।”











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited