দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও বাজার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সরকার ২০২৬ সালের জন্য পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই তেল আমদানি করা হবে সরকার থেকে সরকার (জিটুজি) চুক্তির মাধ্যমে, যাতে বৈশ্বিক বাজারের অস্থিরতার প্রভাব মোকাবিলা করে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বজায় রাখা যায়।
আজ বুধবার অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের কমিটির ৩৪তম সভায় প্রস্তাবটি নীতিগত অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়। সভায় ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
কমিটির আলোচনায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উঠে আসে—পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি এবং ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের উপকরণ সংগ্রহ। উভয় প্রস্তাবই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও জাতীয় প্রয়োজনীয়তার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
২০২৬ সালের জন্য পরিশোধিত তেল আমদানির পরিকল্পনা
সভায় প্রথম প্রস্তাব হিসেবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির জন্য নীতিগত অনুমোদন চায়। প্রস্তাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) জিটুজি পদ্ধতিতে বিভিন্ন দেশ থেকে সরাসরি তেল ক্রয় করবে।
কমিটি প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে নীতিগতভাবে অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করেছে। সিদ্ধান্তে উল্লেখ করা হয়, দেশে জ্বালানি চাহিদা পূরণ ও সরবরাহে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এই উদ্যোগ অত্যন্ত সময়োপযোগী।
অর্থনৈতিক বিষয় কমিটির সদস্যরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামের অস্থিরতা ও ভূরাজনৈতিক সংকটের প্রভাবে বাংলাদেশে তেলের সরবরাহে যেন কোনো ঘাটতি না ঘটে, সেজন্য আগাম আমদানির এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা, আগাম প্রস্তুত বাংলাদেশ
বিশ্ববাজারে চলমান মধ্যপ্রাচ্য সংকট, তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর কোটা নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে তেলের দামে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে সরবরাহ নিশ্চিতে আগেভাগেই পদক্ষেপ নিচ্ছে।
একজন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, “জিটুজি চুক্তি সাধারণত নির্ভরযোগ্য ও স্বচ্ছ পদ্ধতি। এতে মধ্যস্বত্বভোগী কম থাকে এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে সময়মতো তেল সরবরাহ পাওয়া যায়।”
বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ৭০ লাখ টনেরও বেশি পরিশোধিত তেল আমদানি করা হয়। এর মধ্যে ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল ও কেরোসিন অন্তর্ভুক্ত। তেল সরবরাহের বড় অংশ আসে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে।
ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের উপকরণ সংগ্রহেও নীতিগত অনুমোদন
সভায় দ্বিতীয় প্রস্তাব হিসেবে আলোচিত হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ই-পাসপোর্ট ও স্বয়ংক্রিয় সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প।
প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পের আওতায় ১ কোটি ই-পাসপোর্টের কাঁচামাল সংগ্রহ করা হবে, যার মধ্যে জরুরি প্রয়োজনে ৫০ লাখ কাঁচামাল বইয়ে রূপান্তরযোগ্য থাকবে।
এছাড়া, ৫৭ লাখ ই-পাসপোর্ট বই ও সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ প্যাকেজ সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে সংগ্রহের প্রস্তাবও উপস্থাপন করা হয়।
বিস্তারিত পর্যালোচনার পর, কমিটি প্রকল্পটিকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে নীতিগত অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করেছে।
এতে বলা হয়, ই-পাসপোর্ট বিতরণ অব্যাহত রাখা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণ, এবং আন্তর্জাতিক ভ্রমণ নিরাপত্তা জোরদারে এই প্রকল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রকল্পের তাৎপর্য
বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল ই-পাসপোর্টধারী দেশ। ২০২০ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটির আওতায় ইতিমধ্যে প্রায় ২ কোটি নাগরিক ই-পাসপোর্ট পেয়েছেন। নতুন কাঁচামাল সংগ্রহের মাধ্যমে আগামী দুই বছরে আরও বড় পরিসরে পাসপোর্ট বিতরণ কার্যক্রম চলবে।
অন্যদিকে, সীমান্তে স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু হলে ভ্রমণকারীদের তথ্য যাচাই, প্রবেশ-প্রস্থান রেকর্ড ও নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ আরও উন্নত হবে।
আজকের বৈঠকে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির নেওয়া এই দুটি সিদ্ধান্তকে সরকার উন্নয়ন ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে দেখছে।
জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে দেশের শিল্প, পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার হবে, আর ই-পাসপোর্ট প্রকল্প নাগরিক সেবা ও সীমান্ত নিরাপত্তায় নতুন মাত্রা যোগ করবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বৈশ্বিক অস্থিরতা মোকাবিলায় এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনামূলক সিদ্ধান্তই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার মূল চাবিকাঠি হতে পারে।
