দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, রোববার (৬ অক্টোবর) পর্যন্ত এ রিজার্ভের পরিমাণ পূর্ববর্তী মাসের তুলনায় সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি ও আমদানি ব্যয় কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসায় রিজার্ভে এই ইতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্ধারিত হিসাব পদ্ধতি— ব্যালান্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল সিক্স (BPM6) —অনুযায়ী, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ২৬ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। এর কারণ, এই পদ্ধতিতে আইএমএফ ঋণ পরিশোধযোগ্য অংশ, এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ), বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডিএফ)-এর কিছু বরাদ্দসহ আন্তর্জাতিক দায় হিসাবের বাইরে রাখে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, “রিজার্ভের সামগ্রিক চিত্র এখন স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে, পাশাপাশি আমদানি ব্যয় কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।”
তিনি জানান, রিজার্ভের এই অগ্রগতি টেকসই রাখতে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ের প্রবাহ অব্যাহত রাখতে হবে। “আমরা এখন আইএমএফের নির্দেশনা অনুযায়ী রিজার্ভ হিসাব করছি, যা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ,” বলেন মেজবাউল হক।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কিছুটা বাড়লেও তা এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেনি। অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “রিজার্ভের বৃদ্ধি স্বস্তিদায়ক, তবে এখনো আমদানি ব্যয়ের তুলনায় তা ন্যূনতম নিরাপত্তা সীমার কাছাকাছি। রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ে টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে, তাহলে রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকবে।”
রেমিট্যান্সে ইতিবাচক ধারা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর মাসেই এসেছে প্রায় ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি।
রেমিট্যান্স বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে ব্যাংক চ্যানেলে প্রবাসী আয়ের প্রণোদনা বৃদ্ধি ও হুন্ডি নিয়ন্ত্রণকে চিহ্নিত করেছেন বিশ্লেষকেরা। সরকারের প্রণোদনা হিসেবে ২.৫ শতাংশ ক্যাশ ইনসেন্টিভের পাশাপাশি বৈধ পথে টাকা পাঠানোর সুবিধা বাড়ানোয় রেমিট্যান্সে উৎসাহ তৈরি হয়েছে বলে জানান অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।
আমদানি ব্যয় ও ডলারের চাপ
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্য ও জ্বালানির দাম কিছুটা কমে আসায় আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এর ফলে ডলারের ওপর চাপ কমেছে। ব্যাংকিং খাতে ডলার সংকট কিছুটা প্রশমিত হলেও এখনও বাজারে সরবরাহ-চাহিদার ভারসাম্য পুরোপুরি আসেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখতে তারা নিয়মিত হস্তক্ষেপ করছে। গত সপ্তাহে বাজারে প্রায় ৫০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা আমদানি পণ্যের মূল্য পরিশোধে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
আইএমএফের মানদণ্ডে হিসাবের পার্থক্য
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, রিজার্ভের প্রকৃত অবস্থা বোঝার জন্য আইএমএফের BPM6 পদ্ধতি অনুযায়ী হিসাব করা জরুরি। এই পদ্ধতিতে শুধুমাত্র তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহারযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা বাস্তব অর্থে অর্থনীতির সক্ষমতা প্রতিফলিত করে।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আইএমএফ পদ্ধতিতে হিসাব করলে দেখা যায়, আমাদের রিজার্ভ কিছুটা কম। তবে ইতিবাচক দিক হলো, প্রবৃদ্ধির ধারা ফিরছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় ধরে রাখতে পারলে আগামী মাসগুলোতে রিজার্ভ আরও বাড়বে।”
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, চলতি বছরের শেষে রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলার স্পর্শ করতে পারে, যদি আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও প্রবাসী আয়ের ধারা অব্যাহত থাকে। সরকার ইতিমধ্যে রপ্তানি খাতের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বিভিন্ন প্রণোদনা ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্যমতে, রিজার্ভের বর্তমান পরিমাণ দিয়ে প্রায় সাড়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে তুলনামূলক নিরাপদ অবস্থান নির্দেশ করে।
