উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরে সুপারি চাষ এখন কৃষকদের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের নতুন গল্প। একসময় যেখানে ধান ও নারকেল ছিল কৃষির প্রধান ভরসা, সেখানে এখন সুপারি চাষে ঝুঁকছেন হাজারো কৃষক। কম খরচ, রোগ-বালাইয়ের ঝুঁকি কম এবং ভালো বাজারদর—এই তিনটি কারণেই জেলার কৃষকদের মধ্যে সুপারি চাষের প্রতি আগ্রহ দ্রুত বেড়ে চলেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, জেলার পাঁচটি উপজেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার ৩৬০ হেক্টর জমিতে এখন সুপারি বাগান রয়েছে। চলতি মৌসুমে প্রায় সাড়ে ২০ হাজার মেট্রিক টন সুপারি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চাহিদা ও দামে সুখবর
গত বছরের তুলনায় এবার বাজারে সুপারির দাম বেড়েছে ৭–৮ শত টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে প্রতি কাওন (১৬ পোন) সুপারি বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ থেকে ২৮০০ টাকা দরে, যেখানে গত বছর দাম ছিল ১৭০০ থেকে ২২০০ টাকার মধ্যে।
জেলার সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, রামগতি ও কমলনগর উপজেলাসহ শতাধিক বাজারে এখন সুপারির হাট বসছে। দালালবাজার, রসুলগঞ্জ, ভবানীগঞ্জ, মান্দারী ও চন্দ্রগঞ্জ বাজারে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে ক্রয়-বিক্রির ব্যস্ততা।
সুপারি চাষি মনির হোসেন মোল্লা, মোল্লারহাট এলাকা থেকে জানান—
“এবার ফলনও ভালো, দামও ভালো। গত বছরের তুলনায় প্রতি কাওনে প্রায় ৮০০ টাকা বেশি পাচ্ছি। চাষে তেমন খরচ হয় না, আর একবার গাছ লাগালে অনেক বছর ফলন মেলে।”
দালালবাজারের কৃষক নুরনবী বলেন,
“আমি কয়েক বছর আগে অন্য ফসল ছেড়ে সুপারি চাষ শুরু করি। এখন বছরে প্রায় দেড় লাখ টাকা লাভ হয়। আমাদের এলাকার আবহাওয়া সুপারির জন্য খুব উপযোগী।”
লাভজনক কৃষি বিকল্প
সুপারি গাছ একবার রোপণ করলে ২৫–৩০ বছর পর্যন্ত ফলন দেয়, যা কৃষকদের দীর্ঘমেয়াদি আয়ের নিশ্চয়তা দেয়। প্রতি হেক্টরে প্রায় আড়াই থেকে তিন মেট্রিক টন সুপারি উৎপাদন হয়। খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় এই ফসলকে বলা হচ্ছে “গ্রামীণ সোনার ফসল”।
পাশাপাশি, পোকামাকড়ের আক্রমণ কম, পরিচর্যা সহজ এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহারে উৎপাদনও বেড়েছে। এ কারণে অনেক কৃষক ধান, পাট বা সবজি চাষের বদলে সুপারি বাগান সম্প্রসারণে মনোযোগ দিচ্ছেন।
রায়পুর উপজেলার কৃষক জাকির হোসেন বলেন,
“আগে ধান চাষ করতাম, লাভ হতো সামান্য। এখন সুপারি লাগিয়ে বেশি আয় করছি, খরচও অল্প। চাষে তেমন ঝুঁকি নেই।”
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফলন বৃদ্ধি
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, কৃষকেরা এখন সুপারি চাষে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করছেন। সময়মতো সার ও পানি দেওয়া, ছায়া ও বাতাসের সঠিক ব্যবস্থা রাখা, এবং গাছের বয়স অনুযায়ী ফল সংগ্রহ—এসব মানলে ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জহির আহমেদ বলেন,
“এ বছর লক্ষ্মীপুরে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন সুপারি উৎপাদন হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় হাজার কোটি টাকা। কৃষকেরা এখন আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করছে, ফলে ফলন ও মান দুটোই উন্নত হয়েছে।”
তিনি আরও জানান,
“আমরা কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছি—রোগবালাই প্রতিরোধ, পানি নিষ্কাশন এবং সঠিক সার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। এতে তারা আরও লাভবান হচ্ছেন।”
দেশজুড়ে লক্ষ্মীপুরের সুপারির সুনাম
লক্ষ্মীপুরের উৎপাদিত সুপারি এখন শুধু জেলার চাহিদা মেটাচ্ছে না, যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রংপুর, রাজশাহী ও শ্রীমঙ্গলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। মান ও স্বাদের দিক থেকে লক্ষ্মীপুরের সুপারি দেশের বাজারে আলাদা পরিচিতি পেয়েছে।
ব্যবসায়ী মোহাম্মদ কায়সার, ভবানীগঞ্জ বাজারের পাইকার, বলেন—
“লক্ষ্মীপুরের সুপারি সারা দেশে বিক্রি হয়। এখানকার গাছের ফল শুকনো, টেকসই এবং স্বাদে আলাদা। বাজারে এটির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।”
অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা
কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, লক্ষ্মীপুরে সুপারি চাষ স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাড়ছে কর্মসংস্থান, জমির সর্বোত্তম ব্যবহার হচ্ছে, এবং কৃষকরা পাচ্ছেন দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক নিরাপত্তা।
ফলে, এই উপকূলীয় জেলাটি এখন শুধু মাছ ও নারকেলের জন্য নয়—সুপারি উৎপাদনের জেলা হিসেবেও নতুন পরিচিতি পাচ্ছে।
যেমনটা বললেন এক প্রবীণ কৃষক—
“একসময় সুপারি ছিল আঙিনার গাছ, এখন সেটা হয়ে উঠেছে আমাদের ভাগ্য বদলের প্রতীক।”
