রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে শুষ্ক আবহাওয়া ও সেচনির্ভর ধান চাষের জন্য পরিচিত। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষকরা ধানের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে উন্নত জাতের সবজি চাষের দিকে ঝুঁকছেন। এর মধ্যে গ্রীষ্মকালীন ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষ বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মৌসুমি সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে সারা বছর চাষের সুযোগ তৈরি হওয়ায় কৃষকেরা নতুন সম্ভাবনার সন্ধান পাচ্ছেন। এতে শুধু কৃষকের আয় বাড়ছেই না, বরং খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত হচ্ছে।
শীতের ফসল গ্রীষ্মেও
ফুলকপি সাধারণত শীতকালীন সবজি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বর্তমানে রাজশাহীর দুর্গাপুর, গোদাগাড়ী, পবা ও পুঠিয়ার মাঠজুড়ে দেখা যাচ্ছে গ্রীষ্মকালীন ফুলকপি। চাহিদা ও দামের কারণে কৃষকেরা ধান ছেড়ে অসময়ের এই সবজি চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও উন্নত জাতের চারা সরবরাহ এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে।
কৃষকের সাফল্যের গল্প
গোদাগাড়ীর গোলাই গ্রামের কৃষক মুহাম্মদ মিলন ১২ বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, মাত্র এক বিঘা জমি থেকেই তিনি গত সপ্তাহে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার ফুলকপি বিক্রি করেছেন। খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয়েছে কয়েকগুণ। তিনি বলেন,
“প্রথম দিকের ফসল সবসময় বেশি লাভজনক হয়। উৎপাদন খরচ ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার মধ্যে হলেও ফলন অনেক ভালো হচ্ছে।”
অন্যদিকে, ধামিলা গ্রামের কৃষক মনিরুল ইসলাম পাঁচ বিঘা জমিতে বাঁধাকপি চাষ করেছেন। তার আশা, আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যেই বাজারে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের মুনাফা তুলতে পারবেন। বর্তমানে খুচরা বাজারে ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায়, যা কৃষকের জন্য এক সুখবর।
প্রান্তিক কৃষকের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
দুর্গাপুরের চুনিয়াপাড়া গ্রামের শাতাহার আলী মাত্র দেড় বিঘা জমিতে উন্নত জাতের ফুলকপি চাষ করে ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগে ইতোমধ্যেই ৮৫ হাজার টাকা আয় করেছেন। তিনি বলেন,
“প্রতিটি ফুলকপি ক্ষেত থেকে ৮৫-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, আর খুচরা বাজারে যাচ্ছে ১০০ টাকায়। এই মৌসুমে দেড় লাখ টাকারও বেশি বিক্রির আশা করছি।”
তার মতো প্রান্তিক কৃষকরা আশপাশের মানুষকে এই চাষে আগ্রহী করে তুলছেন।
কৃষি বিশেষজ্ঞদের অভিমত
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে সালমা বলেন,
“রাজশাহীতে এখন প্রায় ৩০ হেক্টর জমিতে ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষ হচ্ছে। কৃষকরা উন্নত, উচ্চফলনশীল জাতের দিকে ঝুঁকছেন। এতে তারা শীতকাল ছাড়াও গ্রীষ্মকালেও ভালো আয় করছেন। সবজি চাষ জীবন বদলে দিচ্ছে, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে।”
তিনি আরও জানান, শুধু দেওপাড়া ইউনিয়নের ছয়টি গ্রামে প্রায় ৪৫ জন কৃষক ৩৫০ বিঘা জমিতে গ্রীষ্মকালীন ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষ করছেন।
নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা
সেচনির্ভর ধানের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে কৃষকরা এখন বৈচিত্র্যময় ফসল চাষের দিকে ঝুঁকছেন। এতে শুধু কৃষকের জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে না, বরং বাজারে সবজির চাহিদা পূরণ করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাতেও অবদান রাখছে।
রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল তাই এখন কৃষি উদ্ভাবনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গ্রীষ্মকালীন ফুলকপি চাষ প্রমাণ করছে, সঠিক পরিকল্পনা ও সহায়তায় অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। কৃষকের হাতে গড়া এই সাফল্যের গল্প বাংলাদেশের কৃষিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
