শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার পাহাড়ি জনপদে ফের বন্য হাতির তাণ্ডব। এবার প্রায় ৫ একর আমন ধানের জমি পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করেছে হাতির পাল। ধানের পাশাপাশি ভাঙা মাছের ঘের থেকে বেরিয়ে গেছে হাজার হাজার টাকার মাছ। এতে বিপাকে পড়েছেন অন্তত ১৫ জন কৃষক পরিবার।
ঘটনাটি ঘটেছে শুক্রবার (৩ অক্টোবর) ভোররাতে উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের পশ্চিম সমশ্চূড়া গ্রামের ঝোরাপাড়া এলাকায়। স্থানীয়রা জানান, গভীর রাতে ৩০ থেকে ৩২টি বন্য হাতির একটি পাল সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি বনাঞ্চল থেকে খাদ্যের সন্ধানে নেমে আসে গ্রামে। এরপর তারা একের পর এক কৃষিজমিতে তাণ্ডব চালায়।
ফসল মাড়িয়ে ধ্বংস, ঘের ভেঙে মাছ উধাও
স্থানীয় কৃষক মোশাররফ হোসেন বলেন,
“প্রতি বছরই বর্ষা শেষে হাতির দল লোকালয়ে নামে। এবারও গভীর রাতে হঠাৎ শব্দ শুনে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি পুরো জমি তছনছ। আমার প্রায় ২ একর জমির ধান পা দিয়ে মাড়িয়ে ফেলেছে তারা। শুধু তাই নয়, ধানের পাশে থাকা মাছের ঘেরেও হাতি নেমে পড়ায় দু’পাড় ভেঙে প্রায় ৩০-৪০ হাজার টাকার মাছ বেরিয়ে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা পাহাড়ের মানুষ। এই ফসলই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। সরকার যদি স্থায়ী সমাধান না নেয়, তাহলে এভাবে প্রতিবছরই আমাদের ক্ষতি হতে থাকবে।”
ঋণের টাকায় আবাদ, একরাতে সব শেষ
একই গ্রামের বিধবা কৃষাণী জুলেখা বেগমের কণ্ঠে হতাশা—
“বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে পৌনে দুই একর জমিতে আমন আবাদ করেছিলাম। এখন একরাতেই সব শেষ! যা ছিল, সব মাড়িয়ে দিয়েছে হাতির পাল। এখন না আছে ধান, না আছে টাকার আশা।”
গ্রামের আরও কয়েকজন কৃষক— মো. সাইদ মিয়া, শামসুন্নাহার, আবু বকরসহ প্রায় ১৫ জনের জমিতে একইভাবে ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
বনের খাবার কমে যাওয়ায় লোকালয়ে হাতি
স্থানীয়দের মতে, ভারতের মেঘালয় সীমান্তসংলগ্ন পাহাড়ে পর্যাপ্ত খাবার ও বাঁশঝাড় কমে যাওয়ায় হাতিরা প্রায়ই লোকালয়ে চলে আসে। বিশেষ করে বর্ষা শেষে ফসল কাটার মৌসুমে এদের দেখা মেলে বেশি। গত এক দশকে এ এলাকায় অন্তত ২০ বারের বেশি হাতির আগমন ঘটেছে, যার ফলে প্রতি বছরই কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
প্রশাসনের তৎপরতা
ঘটনার খবর পেয়ে সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন মধুটিলা রেঞ্জের বন কর্মকর্তা মো. দেওয়ান আলী। তিনি বলেন,
“আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জমি পরিদর্শন করেছি এবং প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করছি। যথাযথ নিয়ম মেনে আবেদন করলে সরকারি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।”
তিনি আরও বলেন, “স্থানীয়ভাবে হাতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। মানুষ যাতে অপ্রয়োজনে বনে না যায় এবং হাতির প্রতি উত্তেজিত না হয়, সে বিষয়েও সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে।”
কৃষকদের স্থায়ী সমাধানের দাবি
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কৃষকরা বলছেন, কেবল ক্ষতিপূরণ নয়— বন্য হাতির স্থায়ী প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সীমান্ত এলাকায় ইলেকট্রিক ফেন্সিং, খাদ্য বাফার জোন ও হাতি চলাচলের নিরাপদ করিডর গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন তারা।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্য বলেন,
“প্রতি বছর একই সমস্যা। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, কিন্তু তারচেয়ে বড় প্রয়োজন স্থায়ী সমাধান। না হলে কৃষকেরা ধীরে ধীরে আবাদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।”
চিরাচরিত সমস্যা, তবু সমাধান অধরা
প্রসঙ্গত, মধুটিলা ইকোপার্ক ও সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ি বনাঞ্চল শেরপুরে প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি বন্য হাতির স্থায়ী আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। খাবার ও পানির অভাব, বনাঞ্চলে কাঠ পাচার ও বসতি সম্প্রসারণের কারণে হাতিরা প্রায়ই লোকালয়ে প্রবেশ করছে। গত কয়েক বছরে এই এলাকায় হাতির আক্রমণে একাধিক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষ ও হাতির সহাবস্থানের জন্য টেকসই ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলাই এখন সময়ের দাবি। অন্যথায়, একদিকে ফসলহানি, অন্যদিকে হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
