পশ্চিমবঙ্গের শীতকালীন উৎসব ও দুর্গাপূজা উদযাপনের মধ্যেও ভোট-রাজনীতির কৌশল নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব। দলের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানাচ্ছে, তারা বিশেষভাবে সংখ্যালঘু ভোট, বিশেষত মুসলিম ভোটের পরিমাণ ও ঘনত্ব নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের লক্ষ্য: কোথায় ‘প্রতীকহীন’ সংখ্যালঘু প্রার্থী দাঁড় করানো যায়, যা তৃণমূলের ভোটভিত্তি ভাঙতে সহায়ক হতে পারে।
কৌশল ও পরিকল্পনা
বিজেপির অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, তারা বিশেষ করে মধ্যবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গের আসনগুলোকে লক্ষ্য করে কাজ করছে। এখানে তারা দেখছে—
- ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে কোন কোন কেন্দ্রে তৃণমূল মাত্র ৫,০০০–১০,০০০ ভোট ব্যবধানে জিতেছে;
- কোন কোন কেন্দ্রে ব্যবধান আরও কম, যেখানে সংখ্যালঘু ভোটের প্রভাব সর্বাধিক;
- স্থানীয় সমাজে প্রভাবশালী মুসলিম ব্যক্তিত্ব, সামাজিকভাবে পরিচিত ফুটবলার, ধর্মীয় শিক্ষাবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে;
- এই ব্যক্তিদের ‘প্রতীকহীন’ প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ করে দলের প্রার্থী তালিকা তৈরি হবে এবং নির্বাচনী প্রচারণার জন্য স্থানীয়ভাবে কৌশল প্রণয়ন করা হবে।
‘প্রতীকহীন’ প্রার্থী: কৌশলের নীতি
‘প্রতীকহীন’ প্রার্থী কৌশলটি হল— নির্বাচনে কোনো বড় পার্টির প্রতীক না দেওয়া। ফলে:
- প্রার্থী স্থানীয় স্তরে পরিচিত এবং প্রভাবশালী;
- ধর্ম বা সামাজিক পরিচয়ের মাধ্যমে ভোটাভিনয় সম্ভব;
- প্রধান রাজনৈতিক দল সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে না বলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কম।
বিজেপি সূত্রের মতে, এই কৌশল ব্যবহার করে তারা সংখ্যালঘু ভোট কেটে নিজস্ব সুবিধা নিতে চায়। পূর্বে অন্য রাজ্যগুলিতে এ কৌশল কার্যকর হয়েছে, তবে পশ্চিমবঙ্গের জটিল ভৌগলিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সাফল্য নির্ভর করবে স্থানীয় বাস্তবতার উপর।
ইতিহাস ও উদাহরণ
এ ধরনের কৌশল নতুন নয়। ভারতের কিছু রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোটকে লক্ষ্য করে প্রতীকহীন প্রার্থী দাঁড় করানো হয়েছে। যেমন—
- বিহারে ‘মিম’ ও স্থানীয় দলগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট এলাকায় সংখ্যালঘু ভোটের বিভাজন বিজেপির জন্য সুবিধাজনক হয়েছে।
- ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি ও নওশাদ সিদ্দিকির দল আইএসএফও কিছু ক্ষেত্রে তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটে প্রভাব বিস্তার করতে চেষ্টা করেছে।
তবে, পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে—তৃণমূলের স্থানীয় শক্তি এবং সংখ্যালঘু ভোটের সংহতি এতটাই দৃঢ় যে, কোনো চিহ্নিত প্রার্থী সহজে ভোটবিভাজন ঘটাতে পারবে না।
তৃণমূলের প্রস্তুতি
তৃণমূলও প্রস্তুতি নিচ্ছে—
- সংখ্যালঘু ভোটকে সংরক্ষণ করতে স্থানীয় নেতাদের সক্রিয়করণ;
- ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ;
- ছোট ছোট ইভেন্ট, পিরজাদা ও মসজিদ কমিটি কার্যক্রমের মাধ্যমে ভোটার আস্থা বজায় রাখা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জেলা ও আসনে সংখ্যালঘু ভোট ধরে রাখতে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করান, যদিও কৌশল কেন্দ্রীয়ভাবে সাজানো হয়েছে, ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ভর করবে স্থানীয় বাস্তবতা ও জনগণের মনোভাবের উপর। সংখ্যালঘু ভোটকে লক্ষ্য করে যে কোন পদক্ষেপ রাজনৈতিকভাবে কার্যকর হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক সংহতি ও ভোটার আস্থা রক্ষা করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
নৈতিক ও সংবিধানিক ভাবনা
- ধর্মভিত্তিক কৌশল নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে পারে;
- ভোটের স্বাধীনতা এবং সামাজিক সামঞ্জস্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে;
- বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, ভোট কৌশল এবং ধর্মীয় বিভাজনের মধ্যে সীমা রাখা উচিত।
বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কৌশল যতই বিশ্লেষণধর্মী হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু ভোটের বাস্তব পরিস্থিতি, তৃণমূলের স্থানীয় শক্তি এবং জনগণের প্রত্যাশা চূড়ান্তভাবে নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করবে। ‘প্রতীকহীন’ প্রার্থী চালানো হবে একটি কৌশল হিসেবে, তবে মাঠের বাস্তবতা তা মাপদণ্ড হিসেবে কাজ করবে।
