বাংলায় ভোটার তালিকা সংশোধনের (Special Intensive Revision—‘সার’) কাজ শুরু হতেই ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তে চিত্রটা একেবারে উল্টে গেল। এতদিন যাঁরা দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করতেন, এখন তাঁরাই ফেরত যাওয়ার জন্য মরিয়া। সীমান্তের একাংশে দেখা যাচ্ছে— ‘অনুপ্রবেশকারীরাই’ এখন বিএসএফের কাছে পুশ-ব্যাক চাচ্ছেন!
‘সার’-এর আতঙ্কে উল্টো স্রোত সীমান্তে
গোয়েন্দা সংস্থার সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন শুরুর ঘোষণার পর থেকেই নতুন করে বাংলাদেশ থেকে কেউ ভারতে ঢুকছেন না। বরং ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার হিড়িক পড়েছে।
এদের বেশিরভাগই দীর্ঘদিন ধরে বেআইনিভাবে ভারতে বসবাস করছেন— কেউ ইটভাটায় শ্রমিক, কেউ দিনমজুর, কেউ ছোটখাটো ব্যবসায়ী। এখন তাঁরা আশঙ্কায় ভুগছেন— ভোটার তালিকা যাচাইয়ের সময় ধরা পড়লে আইনি জটিলতায় পড়তে হবে। তাই পালিয়ে নিজেদের দেশে ফিরে যেতে চাইছেন অনেকেই।
২৪ ঘণ্টায় ধৃত ৫৫ জন বাংলাদেশি
শুধু গত ২৪ ঘণ্টায়ই উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগর সীমান্ত থেকে ধরা পড়েছেন ৫৫ জন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী।
বিএসএফ সূত্রে জানা গেছে, এঁরা প্রত্যেকেই দালালের মাধ্যমে অতীতে ভারতে ঢুকেছিলেন। কেউ কয়েক বছর ধরে বসবাস করছেন, কেউবা সদ্য এসেছেন। এখন তাঁরা নিজেরাই সীমান্তে গিয়ে বিএসএফ জওয়ানদের অনুরোধ করছেন—
“আমাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিন, ভারতে থাকা নিরাপদ নয়।”
স্থানীয় বাসিন্দারাও জানিয়েছেন, গত কয়েকদিন ধরেই ভোরের দিকে বড় বড় ব্যাগ হাতে দল বেঁধে মানুষ সীমান্তে আসছেন। কেউ গোপনে দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফেরার চেষ্টা করছেন, কেউ আবার সরাসরি বিএসএফের কাছে আত্মসমর্পণ করছেন।
বিএসএফের তৎপরতা, পুলিশের হাতে হস্তান্তর
বিএসএফ জানিয়েছে, শুক্রবার ১০ জন এবং শনিবার আরও ৪৫ জন বাংলাদেশি অবৈধভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার চেষ্টা করছিলেন। তাঁদের হাকিমপুর সীমান্তে আটক করা হয়। এরপর নিয়ম মেনে স্বরূপনগর থানার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
পুলিশ সূত্রে খবর, ধৃতদের বাড়ি বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, নড়াইল, বাগেরহাট ও যশোর জেলায়। শনিবার তাঁদের বসিরহাট মহকুমা আদালতে তোলা হলে বিচারক ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দেন।
এক জেলা পুলিশের আধিকারিক বলেন,
“বাংলায় ‘সার’ শুরু হতেই সীমান্তে বিএসএফের নজরদারি আরও কড়াকড়ি হয়েছে। ফলে একদিকে নতুন অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়েছে, অন্যদিকে পুরোনো অনুপ্রবেশকারীরাই ধরা পড়ছেন বা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করছেন।”
দালাল চক্র সক্রিয়, নতুন সংকট
তবে প্রশাসনের উদ্বেগ অন্য জায়গায়। সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় এখন দালালচক্র নতুন করে সক্রিয় হয়েছে। তাঁরা ভারতে থাকা বাংলাদেশিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ফেরত পাঠানোর ‘ব্যবস্থা’ করে দিচ্ছেন।
একজন স্থানীয় বাসিন্দার কথায়,
“যেভাবে অনেকে বাংলাদেশে ফেরার জন্য দালালের পিছু নিচ্ছেন, তাতে আবারও পাচারচক্র মাথাচাড়া দিতে পারে।”
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যাচ্ছে, সীমান্ত এলাকার এই দালালরাই এতদিন বিপরীত পথে মানুষ পাচারের কাজ করত। এখন পরিস্থিতি ঘুরে যাওয়ায় তাদের ‘রুট’ উল্টো দিকেই সক্রিয়।
‘সার’-এর প্রভাব ও প্রশাসনের তৎপরতা
নির্বাচন কমিশনের ‘সার’ বা বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া অনুযায়ী ভোটার তালিকা পুনর্গঠন হচ্ছে রাজ্যজুড়ে। এ সময় নাগরিকত্ব যাচাই ও তথ্য যাচাইয়ের প্রক্রিয়া জোরদার হবে।
ফলে যাঁরা বেআইনিভাবে ভারতে বাস করছিলেন, তাঁদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গোপনে আত্মগোপনে থাকা অনেকেই এখন নিরাপদে দেশে ফেরার পথ খুঁজছেন।
এক সিনিয়র গোয়েন্দা কর্তা বলেন,
“বাংলায় ভোটার তালিকা সংশোধনের সময় তথ্য যাচাই প্রক্রিয়া কড়াকড়ি হবে— এ খবরেই আতঙ্ক ছড়িয়েছে অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে। এ কারণেই সীমান্তে এখন উল্টো স্রোত দেখা যাচ্ছে।”
স্বরূপনগরে নিরাপত্তা জোরদার
এই পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে বিএসএফ। স্বরূপনগর, বাগদা, পেট্রাপোল ও বসিরহাট উপকণ্ঠে টহলদারি বাড়ানো হয়েছে। সন্দেহজনক ব্যক্তিদের ওপর নজরদারির পাশাপাশি স্থানীয় গ্রামবাসীদেরও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন,
“যাঁরা বৈধ কাগজপত্র ছাড়া সীমান্ত পেরোচ্ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে দালালচক্রের বিরুদ্ধেও অভিযান চলছে।”
‘সার’ বা ভোটার তালিকা সংশোধনের প্রক্রিয়া শুধু প্রশাসনিক কাজ নয়, বরং এটি সীমান্ত অঞ্চলের সামাজিক বাস্তবতাকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতে গোপনে বসবাস করা বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে যে ভয় ও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে, তা এখন সীমান্তে এক নতুন চিত্র তৈরি করেছে—
অনুপ্রবেশ নয়, বরং স্বদেশে ফেরার হিড়িক।


সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited