দীপান্বিতা অমাবস্যা মানেই দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে উৎসবের আবহ। প্রতি বছর এই দিনে হাজারো ভক্তের ঢল নামে অধিষ্ঠাত্রী দেবী বুড়াকালী মন্দিরে। শতাব্দি প্রাচীন এই পুজোকে ঘিরে আজও জমে ওঠে মেলা, আলোয় সাজে শহর, আর ভক্তির স্রোতে ভাসে আত্রেয়ী নদীর তীর।
আত্রেয়ীর তীরে জন্ম কাহিনি
লোকমুখে প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী, কয়েকশো বছর আগে যেখানে আজ বুড়াকালী মন্দির দাঁড়িয়ে, সেখানেই ছিল ঘন জঙ্গল ও আত্রেয়ী নদীর ধার। সেই সময় এক রাতে নদীর জলে ভেসে ওঠে বুড়া কালীমাতার বিগ্রহ। স্থানীয় এক তান্ত্রিক নাকি স্বপ্নে দেবীকে দর্শন পেয়ে সেই বিগ্রহ উদ্ধার করে পুজো শুরু করেন।
প্রথমে বাঁশ ও টিনের ছাউনি দিয়ে সামান্য জায়গায় পুজো শুরু হলেও ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে স্থায়ী মন্দির। এখন সেখানে বিরাট প্রাঙ্গণে জাঁকজমকভাবে হয় মা বুড়াকালীর পূজা।
দীপান্বিতা অমাবস্যায় হাজারো ভক্ত
দীপাবলির রাতে যখন সারা দেশে প্রদীপের আলো জ্বলে ওঠে, তখন বালুরঘাটের বুড়াকালী মন্দিরও ভরে ওঠে আলো ও ভক্তিতে।
পুজোর দিন ভোর থেকেই মন্দির চত্বরে ভক্তদের ভিড় লেগে যায়। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন মানত পূরণ করতে। দক্ষিণ দিনাজপুর ছাড়াও উত্তর দিনাজপুর, মালদা, এমনকি মুর্শিদাবাদ থেকেও বহু মানুষ আসেন এই ঐতিহ্যবাহী পুজোয় অংশ নিতে।
পুজোর প্রধান আকর্ষণ মায়ের অলঙ্কার। পুজোর দিন মা বুড়াকালীর সারা শরীর সোনা ও রুপার গয়নায় সজ্জিত করা হয়। বিশেষ করে সোনার মুখমণ্ডলটি প্রতি বছর লকার থেকে বের করে পুজোর সময় স্থাপন করা হয়, পরে আবার সংরক্ষণ করা হয়।
বলির প্রথা ও রীতি-রেওয়াজ
বুড়াকালী পুজোতে এখনো টিকে আছে পুরোনো বলি প্রথা। পুজোর দিন পাঁঠা ও শোল মাছ বলি দেওয়া হয়। পুরোনোদের মুখে শোনা যায়— একসময় নাকি ২০ কিলো ওজনের শোল মাছ বলি দেওয়া হতো! যদিও এখন সেই প্রথা সীমিত আকারে পালিত হয়, কিন্তু বিশ্বাস ও ভক্তির গভীরতা কমেনি।
মন্দির প্রাঙ্গণে পুজো উপলক্ষে আয়োজন করা হয় অন্নভোগ বিতরণের। শত শত মানুষ বসে একসঙ্গে প্রসাদ গ্রহণ করেন।
বুড়া কালী পূজা সমিতির সম্পাদক অমিত মহন্ত বলেন,
“পুরোনো রীতি রেওয়াজ মেনেই পুজো হয়। মা’কে আমরা যেমন পেয়েছি, তেমনি ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করি। পুজোর দিন সোনার মুখমণ্ডল স্থাপন করা হয়, পরে সেটি সযত্নে লকারে রাখা হয়।”
রানি রাসমণির কিংবদন্তি
এই মন্দির ঘিরে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। স্থানীয় প্রবীণরা বলেন, কলকাতার রানি রাসমণি নাকি বজরায় চড়ে আত্রেয়ী নদীপথে এসে মা বুড়াকালীর পুজো দিতেন।
তিনি নদী থেকে জল তুলে এনে পুজো করতেন, পরে একই পথে ফিরে যেতেন কলকাতায়। যদিও ইতিহাসে এর প্রমাণ মেলেনি, তবু এই কিংবদন্তি আজও জীবন্ত রয়েছে বালুরঘাটবাসীর মনে।
রহস্যের গন্ধ
আরও এক প্রচলিত গল্প শোনা যায়— সন্ধ্যার পর নাকি মন্দির সংলগ্ন এলাকায় ভেসে আসত এক অদ্ভুত ফুলের গন্ধ, সঙ্গে শোনা যেত নুপুরের আওয়াজ। অথচ আশেপাশে ছিল না কোনো বাগান বা গাছপালা! স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, দেবী নিজেই উপস্থিত হয়ে আশীর্বাদ দিতেন ভক্তদের।
ঐতিহ্য ও ভক্তির মেলবন্ধন
আজকের দিনে যখন শহুরে ব্যস্ততায় মানুষ দেবভক্তি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তখনও বালুরঘাটের বুড়াকালী পুজো যেন এক জীবন্ত ঐতিহ্য।
এখানে ধর্ম শুধু বিশ্বাস নয়— এটি সামাজিক মিলনেরও প্রতীক। দীপান্বিতা অমাবস্যার এই রাতে বুড়াকালী মন্দির তাই হয়ে ওঠে ভক্তি, আনন্দ ও লোকসংস্কৃতির এক মিলনক্ষেত্র।
রানি রাসমণির কিংবদন্তি হোক বা তান্ত্রিকের গল্প— সবকিছু মিলিয়ে বুড়াকালী পুজো বালুরঘাটবাসীর হৃদয়ে আজও এক অমোঘ আধ্যাত্মিক আলো হয়ে জ্বলছে।
