তারা মানুষ নয়, কিন্তু মানুষের মতোই দায়িত্বশীল। তারা কথা বলতে পারে না, কিন্তু কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে— সহানুভূতি, সাহস আর কর্তব্যবোধ কেবল মানুষের একচেটিয়া নয়। উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় অসাধারণ সাহসিকতা ও দায়িত্ববোধ দেখানোর জন্য ১০টি কুনকি হাতিকে বিশেষ পুরস্কার দিতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ বনদপ্তর।
গত ৫ অক্টোবর উত্তরবঙ্গজুড়ে একের পর এক জায়গায় প্রবল বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সাধারণ জীবন। বনাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়ে, নদীর সেতু ভেসে যায়, বহু পর্যটক ও স্থানীয় বাসিন্দা আটকে পড়েন। ঠিক তখনই উদ্ধার অভিযানে নামে বনকর্মী, এনডিআরএফ ও সিভিক ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে এই বিশালদেহী কিন্তু সংবেদনশীল কুনকি হাতিরা।
জলদাপাড়ায় পর্যটক উদ্ধার: বুকসমান জলে এগিয়ে এল হাতিরা
৫ অক্টোবর রাতে মাদারিহাটের হলং নদীর উপরে থাকা কাঠের সেতু ভেসে যায়। সেই সেতু ছিল জলদাপাড়া ট্যুরিজম লজে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা। সেতু ভেসে যাওয়ার ফলে ২৮ জন পর্যটক লজে আটকা পড়ে যান। উদ্ধারকাজ শুরু হয় অন্ধকারে, ভয়াবহ স্রোতের মধ্যে। তখন বুকসমান জলে প্রবেশ করে আটজন পর্যটককে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসে জলদাপাড়ার কুনকি হাতিরা— মীনাক্ষী, বলরাম, শম্ভু ও দেবাঙ্গী। মাহুতদের নির্দেশে তারা একের পর এক মানুষকে স্রোত পার করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেয়।
বন দপ্তরের এক কর্তা জানান, “মানুষের মতোই এই কুনকি হাতিরা পরিস্থিতি বুঝে দ্রুত কাজ করেছে। তাদের অবদানের কারণে বড় বিপর্যয় এড়ানো গেছে।”
বন্যপ্রাণী রক্ষায়ও অনন্য ভূমিকা
এখানেই শেষ নয়। একই দিনে তোর্সা নদীর জলে ভেসে গিয়েছিল কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার এলাকার বহু বন্যপ্রাণী— গন্ডার, বাইসন, হরিণ ও বুনো শুয়োর। ভয় পেয়ে তারা আশ্রয় নেয় স্থানীয় লোকালয়ে। মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণীর সংঘাত এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় কুনকি হাতিরা। কখনও কাদায় ভরা রাস্তা পেরিয়ে, কখনও কোমরসমান জলে নেমে তারা বিপদগ্রস্ত প্রাণীদের বনাঞ্চলে ফিরিয়ে আনে।
বনকর্মীরা জানান, “এই হাতিরা দিনের পর দিন প্রায় না খেয়ে কাজ করেছে। অনেক সময় শুধু কলাগাছ আর অল্প জলই ছিল খাদ্য। তবুও দায়িত্বে একটুও ফাঁকি দেয়নি তারা।”
বিশেষ পুরস্কার ও স্বীকৃতি
বনদপ্তর জানিয়েছে, জলদাপাড়া ও গোরুমারা জাতীয় উদ্যানের এই ১০ কুনকি হাতির নাম তাদের সার্ভিস রেকর্ডে বিশেষ অবদানের হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হবে। এর ফলে তারা অবসরের পরেও অতিরিক্ত সুবিধা ও যত্ন পাবে। এই ‘সার্ভিস রেকর্ড স্বীকৃতি’ই হবে তাদের প্রকৃত পুরস্কার।
তাদের সঙ্গে থাকা মাহুত ও পাতাওয়ালাদেরও আলাদা করে সম্মান জানানো হবে। রবিবার হাসিমারার নীলপাড়া রেঞ্জে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে এক রিভিউ মিটিংয়ে আটজন সরকারি ও আধা সরকারি কর্মীকে পুরস্কৃত করা হয়। ঠিক তার পরেই ঘোষণা করা হয় কুনকি হাতিদের জন্য বিশেষ সম্মাননা।
উত্তরবঙ্গের বন্যপ্রাণ শাখার মুখ্য বনপাল ভাস্কর জে. ভি. বলেন, “ওরা হয়তো মানুষ নয়, কিন্তু দুর্যোগের সময় ওদের সাহসিকতা আর দায়িত্ববোধ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। এই পুরস্কার তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রতীক।”
পুরস্কৃত হাতিরা
এই ১০ ‘নায়ক’ হাতি হল— মীনাক্ষী, শম্ভু, বলরাম, ডায়না, সুন্দরমনি, জয়, নাজুন্ডা, লক্ষ্মণ, দেবাঙ্গী এবং মেনকা। এদের প্রত্যেকেই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন বনাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বনদপ্তরের সহকারী হিসেবে কাজ করছে।
উল্লেখযোগ্য, এর আগে ২০১০ সালে ঝাড়খন্ড থেকে পুরুলিয়া-বাঁকুড়ায় ঢুকে পড়া বুনো হাতির পালের তাণ্ডব নিয়ন্ত্রণে অসাধারণ ভূমিকা রাখার জন্য মীনাক্ষী ও শম্ভুকে পুরস্কৃত করেছিল রাজ্য বনদপ্তর।
‘না-মানুষ’দের মানবিকতা
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো এই হাতিদের কাহিনি শুধু একটিমাত্র উদ্ধার অভিযান নয়, বরং এক দৃষ্টান্ত। তাদের নিঃস্বার্থ কাজ প্রমাণ করেছে— মানবিকতার মাপকাঠি প্রজাতি নয়, মন।
এ যেন প্রকৃতির সন্তানদেরই হাত ধরে প্রকৃতি ফিরিয়ে দিল জীবনের পাঠ— সহানুভূতি, দায়িত্ব আর সাহসের।
