উত্তরবঙ্গ এখন প্রকৃতির ভয়াবহ রূপের সাক্ষী। প্রবল বর্ষণে ফুঁসছে তোর্সা, জলঢাকা, হলংসহ একাধিক নদী। জলের তোড়ে শুধু গ্রাম-গঞ্জ নয়, বিপন্ন বন্যপ্রাণীরাও চরম বিপর্যয়ে পড়েছে। জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান থেকে ভেসে আসা একটি গন্ডারের তোর্সার স্রোতে টিকে থাকার মরিয়া চেষ্টা—সেই দৃশ্যই এখন কাঁপিয়ে তুলেছে গোটা দেশ।
এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য:
শীলবাড়ি হাটের কাছে ২৭ নম্বর জাতীয় সড়কের শীল তোর্সা সেতু থেকে তোলা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, প্রবল স্রোতে ভেসে চলেছে একটি গন্ডার। প্রাণ বাঁচাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সেটি ভেসে যায় কোচবিহার অভিমুখে। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেটিজেনরা হতবাক—শিউরে উঠছেন বন্যপ্রাণীর এই করুণ পরিণতি দেখে।
প্রকৃতির প্রলয়—বিপন্ন প্রাণীকুল:
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, টানা বৃষ্টিতে তোর্সা, জলঢাকা ও হলং নদীর জলে তোড়ে ভেসে গেছে হরিণ, বাইসন ও লেপার্ডসহ বহু প্রাণী। নদীর জলে ভেসে আসা বিশালাকৃতির কাঠের গুঁড়ি ও ভাঙা গাছের আঘাতে অনেক প্রাণীর মৃত্যু ঘটেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, শালকুমার হাটের সুঁড়িপাড়া ও শিমলাবাড়ি এলাকায় আরও দুটি গন্ডার ভেসে এসেছে। স্থানীয়রা বিষয়টি বনবিভাগকে জানালে দ্রুত উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। বনকর্মীরা প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন বন্যপ্রাণীগুলিকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে।
গরুমারার হাতিরাও বিপদে:
জলপাইগুড়ি জেলার গরুমারা জাতীয় উদ্যানের রামসাই এলাকায় শাবকসহ প্রায় ১২টি হাতি এখন গ্রামের পাশে আটকা পড়েছে। জলঢাকা নদীর জলস্তর বেড়ে যাওয়ায় তারা বনে ফিরতে পারছে না। স্থানীয় প্রশাসন ও বনবিভাগ হাতিগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছে এলাকা।
পর্যটন ও যোগাযোগে বিপর্যয়:
মাদারিহাটে জলদাপাড়া ট্যুরিজম লজে যাওয়ার কাঠের সেতুটি ভেসে আসা গাছের আঘাতে বেঁকে গিয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। ফলে রবিবার সকাল থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জিপসি সাফারি ও হাতি সাফারি—আটকে পড়েছেন বহু দেশি-বিদেশি পর্যটক।
এছাড়াও শিশামারা নদীর জলে ফুলে ওঠায় তিনটি বেসরকারি রিসোর্ট সম্পূর্ণ জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। পর্যটকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে।
প্রশাসনের সতর্কতা ও উদ্ধার তৎপরতা:
আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ির প্রশাসন জানিয়েছে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি টিম কাজ করছে। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও ডিএফও স্বয়ং তদারকিতে রয়েছেন। ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে এক হাজারের বেশি পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরানো হয়েছে।
ভুটানের জলপ্রবাহে নতুন আশঙ্কা:
প্রতিবেশী দেশ ভুটানের টালা হাইড্রোল প্রজেক্টের স্লুইস গেট অতিরিক্ত জলের কারণে খুলছে না। গেটের গঠন দুর্বল হয়ে পড়ায় ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভুটান প্রশাসন ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সতর্ক করেছে।
বনবিভাগের আহ্বান:
জলদাপাড়ার বনবিভাগ স্থানীয়দের উদ্দেশে অনুরোধ জানিয়েছে, নদীপথে বা তীরে কোনও প্রাণী ভেসে এলে তাদের বিরক্ত না করে বনকর্মীদের খবর দিতে। বর্তমানে উদ্ধারকর্মীরা জলদাপাড়া, গরুমারা, ও আলিপুরদুয়ার এক ব্লকের বিভিন্ন স্থানে দিনরাত কাজ করছেন।
উত্তরবঙ্গের মানুষ যেমন নিজেদের ঘরবাড়ি রক্ষায় লড়ছে, তেমনি বনকর্মীরা লড়ছেন প্রকৃতির সঙ্গে বাঁচার জন্য প্রাণীদের হয়ে। তোর্সার ফুঁসে ওঠা জলে ভেসে যাচ্ছে একের পর এক জীবনের গল্প—যেখানে প্রকৃতি আর প্রাণ এখন একই স্রোতের মধ্যে বাঁচার লড়াইয়ে।


সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited