ওডিশার জঙ্গলমহলে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ গেল পূর্ণ বয়স্ক হাতি ‘কলিঙ্গ’-র। বহু বছর ধরে এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত এই বন্য হাতিটির আকস্মিক মৃত্যুতে গোটা অঞ্চলে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। ঘটনার পর স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চালক চাইলে ট্রেনটি সহজেই থামাতে পারতেন।
ঘটনাটি ঘটে শনিবার গভীর রাতে বলেশ্বর-ভদ্রক রেলপথের কুলাদি জঙ্গলের কাছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ট্রেনটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে যাচ্ছিল। সেই সময় জঙ্গলের ভেতর থেকে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করছিল কলিঙ্গ ও তার দলের আরও কয়েকটি হাতি। হঠাৎ করেই ট্রেনের সামনে পড়ে যায় কলিঙ্গ, আর সজোরে ধাক্কা লেগে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। দুর্ঘটনার শব্দে কেঁপে ওঠে চারপাশ, ট্রেনের ধাক্কায় হাতিটি প্রায় কয়েক মিটার দূরে ছিটকে পড়ে।
স্থানীয়রা সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং বনদপ্তরে খবর দেন। তবে ততক্ষণে হাতিটির মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যায়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় বনদপ্তর ও রেল পুলিশের টিম। বনদপ্তরের কর্মকর্তারা পরে নিশ্চিত করেন, “হ্যাঁ, কলিঙ্গ নামের পূর্ণ বয়স্ক হাতিটি ট্রেনের ধাক্কায় মারা গেছে। ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং আমরা তদন্ত শুরু করেছি।”
স্থানীয়দের অভিযোগ, এই রুটে প্রায়ই হাতির দল চলাচল করে, অথচ রেল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো সতর্কতা ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। “প্রতিবারই আমরা বনদপ্তরকে বলেছি যে, রাতের সময় ট্রেনের গতি কমাতে হবে। কিন্তু কেউ শোনে না। আজ তারই মাশুল দিতে হলো কলিঙ্গকে,” ক্ষোভ ঝাড়লেন এক গ্রামবাসী।
কলিঙ্গ শুধু একটি বন্যপ্রাণী ছিল না—এলাকাবাসীর কাছে ছিল প্রিয় মুখ। প্রায়ই তাকে দেখা যেত ধানক্ষেতের ধারে বা জঙ্গলের প্রান্তে। গ্রামের অনেকেই বলছিলেন, কলিঙ্গের মৃত্যু যেন পরিবারের একজন সদস্য হারানোর মতো।
সামাজিক মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে দুর্ঘটনার ভিডিও ও ছবি (যার সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা হয়নি)। সেখানে দেখা গেছে, রেললাইনের পাশে পড়ে আছে বিশালাকৃতির হাতির দেহ, পাশে জড়ো হয়েছেন শত শত মানুষ। অনেকেই কাঁদছেন, কেউ কেউ ট্রেন চালকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলছেন।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে অভ্যন্তরীণ সূত্রের দাবি, ঘটনাটি হঠাৎ ঘটেছে এবং চালক যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও সময়মতো ট্রেন থামাতে পারেননি। বনদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার পর থেকে ওই এলাকায় হাতির দল আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রাণীর চলাচল নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
প্রাণী অধিকার সংগঠন ও পরিবেশবাদীরা রেলওয়ের অবহেলার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তাঁদের দাবি, “এমন দুর্ঘটনা নতুন নয়। প্রতিবছরই হাতি বা হরিণের মৃত্যু হয় ট্রেনের ধাক্কায়। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা একই রকম রয়ে গেছে। রাতের বেলা হাতি চলাচল এলাকায় গতি নিয়ন্ত্রণ বা সেন্সরভিত্তিক সতর্কতা ব্যবস্থা চালু করলেই এমন মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।”
রাজ্য সরকারের বন ও পরিবেশ দপ্তর ইতিমধ্যে ঘটনাটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনাস্থলে একটি সমন্বিত পরিদর্শন টিম পাঠানো হবে এবং ভবিষ্যতে এই রুটে প্রাণী সুরক্ষার জন্য নতুন ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে, রোববার সকালে কলিঙ্গের মৃতদেহের দাহ সম্পন্ন হয় বনদপ্তরের তত্ত্বাবধানে। উপস্থিত ছিলেন বহু স্থানীয় মানুষ ও স্কুল শিক্ষার্থীরা। ফুল ও মালা দিয়ে তারা শেষ শ্রদ্ধা জানায় কলিঙ্গকে।
গ্রামবাসী হরিহর দাসের কথায়, “ও আমাদের সবার প্রিয় ছিল। ক্ষেতে আসলে আমরা ভয় পেতাম না, বরং খাওয়ার কিছু দিতাম। আজ যেন জঙ্গলের নীরবতা আরও গভীর হয়ে গেছে।”
কলিঙ্গের মৃত্যু আবারও প্রশ্ন তুলেছে, রেললাইন বরাবর বন্যপ্রাণী সুরক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা কবে বাস্তবায়ন হবে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে এখন ওডিশার মানুষ—আর জঙ্গলের নীরবতায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কলিঙ্গের হারিয়ে যাওয়া পায়ের শব্দ।

সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited