দীপাবলি ও কালীপূজার উৎসবকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় সমুদ্রসৈকত দিঘা ও মন্দারমণি ভরে উঠেছে পর্যটকে। যদিও ছুটির মরশুম শুরুর আগে হোটেলগুলোর আগাম বুকিং আশানুরূপ হয়নি, কিন্তু শেষ সপ্তাহান্তে পরিস্থিতি পুরো পাল্টে যায়। দীপাবলির লম্বা ছুটি ও উইকেন্ড মিলে কয়েক দিনে পর্যটকদের ঢল নামে দিঘা উপকূলে।
ফলে মুখে হাসি ফুটেছে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হোটেল মালিক, পরিবহন ব্যবসায়ী ও স্থানীয় দোকানিদের। সৈকতে সূর্যাস্ত উপভোগ করা থেকে শুরু করে জগন্নাথ মন্দিরে পূজা— সব জায়গায়ই ছিল মানুষের ভিড়।
বুকিং কম, কিন্তু ভিড়ে উপচে পড়া শহর
দিঘা-শঙ্করপুর হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক বিপ্রদাস চক্রবর্তী জানান, “দীপাবলির আগে আগাম বুকিং কিছুটা কম ছিল। কিন্তু হঠাৎই স্পট বুকিং বেড়ে যায়। বর্তমানে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ রুম ভর্তি। দীপাবলির ছুটির সঙ্গে টানা সপ্তাহান্ত যুক্ত হওয়ায় পর্যটকেরা হুড়োহুড়ি করে চলে এসেছেন।”
হোটেল মালিকদের মতে, ভাইফোঁটার পর থেকেই অনেকের অফিস-স্কুল খুলে যাবে, তাই সবাই এই ছুটির সুযোগে পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। আগাম বুকিং না থাকলেও “লাস্ট-মিনিট” ভ্রমণকারীদের কারণে শহরের প্রতিটি রাস্তাই জমজমাট হয়ে ওঠে।
জগন্নাথ মন্দিরে ধর্মীয় আবহ
দিঘার নতুন আকর্ষণ এখন জগন্নাথ মন্দির। এ বছরের এপ্রিল মাসে উদ্বোধনের পর থেকেই মন্দিরটি পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠেছে। মন্দির কর্তৃপক্ষের হিসেবে, দুর্গাপূজা থেকে দীপাবলি পর্যন্ত প্রায় এক লাখেরও বেশি দর্শনার্থী এখানে এসেছেন।
দিঘা জগন্নাথ মন্দির ট্রাস্টি কমিটির সদস্য রাধারমণ দাস জানান, “এই প্রথম দীপাবলি ও গোবর্ধন পুজো একসঙ্গে পালন হচ্ছে। পুণ্যার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। দুর্গাপুজোর সময় যেমন প্রায় সাত লাখ দর্শনার্থী এসেছিলেন, দীপাবলিতেও সেই সংখ্যার কাছাকাছি মানুষ এসেছেন।”
বুধবার মন্দিরে অনুষ্ঠিত হবে অন্নকূট উৎসব ও গোবর্ধন পুজো। স্থানীয় প্রশাসন আশা করছে, এই দিনটিতে দিঘায় পর্যটক সংখ্যা আরও বাড়বে।
সৈকতে উৎসবের আমেজ
দিঘার সমুদ্র সৈকতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পর্যটকদের ভিড় লেগেই ছিল। বাচ্চারা খেলায় মত্ত, যুবকরা সেলফি তুলতে ব্যস্ত, আর পরিবারগুলো ছাতার নিচে বসে আড্ডায় মেতে উঠেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ। খাবারের দোকান, খেলনা, কচুরি-চপের স্টল— সব জায়গাতেই ছিল রমরমা ব্যবসা।
এক হোটেল মালিক বলেন, “আগে ভাবছিলাম বুকিং কম, এবার হয়তো ক্ষতি হবে। কিন্তু শেষ তিন দিনে সব ঘর ফু্ল হয়ে গেছে। এটা পর্যটনের জন্য খুবই ইতিবাচক।”
প্রশাসনের তৎপরতা
পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে জেলা প্রশাসনও ছিল সচেতন। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পুলিশ সুপার সৌম্যদীপ ভট্টাচার্য জানান, “দিঘা ও মন্দারমণিতে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সাদা পোশাকে পুলিশ টহল দিচ্ছে, পাশাপাশি মহিলা পুলিশের বিশেষ টিমও রয়েছে। পর্যটকদের যেন কোনও অসুবিধা না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক নজরদারি চলছে।”
দিঘা-শঙ্করপুর ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (DSDA) জানিয়েছে, সৈকতের পরিচ্ছন্নতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনাতেও বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে ক্রমবর্ধমান পর্যটক চাপের মধ্যেও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যায়।
উৎসবের শেষে আশাবাদ
দীপাবলির এই ভিড়ে দিঘার পর্যটন শিল্প যেন আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর বার্তা পেল। হোটেল ব্যবসায়ী, রিকশাচালক, দোকানদার— সবার মুখে হাসি।
রাধারমণ দাসের কথায়, “দিঘা এখন শুধু সাগর নয়, এটা হয়ে উঠছে একসঙ্গে ধর্মীয় ও পারিবারিক পর্যটনের কেন্দ্র। যদি প্রশাসন ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে কাজ করেন, তাহলে আগামী মৌসুমে আরও বড় রেকর্ড হতে পারে।”
উৎসবের এই রঙিন সময় শেষে আবারও প্রমাণ হলো— দিঘার জাদু এখনও অমলিন। একটু ছুটি, একটু সাগর আর একটু আলো— এই তিন মিলে দীপাবলিতে দিঘা পরিণত হলো আনন্দের সমুদ্রতটে।
