পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা দিঘা থেকে অল্প দূরেই এক অদ্ভুত কিংবদন্তিতে মোড়া স্থান—রামনগরের মীরগোদা গ্রাম। এখানে শতাব্দীপ্রাচীন এক মন্দিরে পূজিত হন দেবী লঙ্কেশ্বরী, যাঁকে স্থানীয়রা শ্রদ্ধাভরে ডাকেন ‘লঙ্কার অধিষ্ঠাত্রী মা’ বলে। এই দেবীর ভক্তদের বিশ্বাস—যিনি একসময় রাবণের রক্ষা-দেবী ছিলেন, তিনি রাবণের অন্যায় সীতাহরণের প্রতিবাদে নিজেই লঙ্কা ত্যাগ করে সমুদ্রপথে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাংলার মাটিতে।
কথিত আছে, রাবণের কর্মকাণ্ডে ক্রুদ্ধ হয়ে দেবী লঙ্কেশ্বরী লঙ্কা ছেড়ে চলে আসেন এই মীরগোদায়। এরপর থেকে এখানেই তিনি প্রতিষ্ঠিত হন এবং স্থানীয় মানুষের পূজার্চনায় পরিণত হন বাংলার এক জাগ্রত দেবীতে। যদিও এই ইতিহাসের কোনো লিখিত প্রমাণ নেই—সবটাই লোকমুখে প্রচলিত কাহিনি।
ধ্বংসাবশেষ ও ভাঙা হাতের দেবী
স্থানীয়দের মতে, একসময় এই মন্দির ছিল অনেক বৃহৎ ও সমৃদ্ধ। কিন্তু কালাপাহাড়ের আক্রমণে তা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সেই সময়েই দেবীর মূল মূর্তির এক হাত ভেঙে যায়। আশ্চর্যের বিষয়, আজও সেই ভাঙা হাতের মূর্তিতেই নিয়মিত পূজা হয়, আর ভক্তদের বিশ্বাস—এই ভাঙা হাতই দেবীর জাগ্রত শক্তির প্রতীক।
প্রতিদিনই এখানে মানত পূরণের আশায় ভিড় করেন শত শত মানুষ। ভোগ নিবেদনের পাশাপাশি ভক্তরা মন্দির চত্বরের পাশের একটি প্রাচীন গাছকেও পূজা দেন। স্থানীয় ধারণা, এই গাছেরও দেবীর সঙ্গে আধ্যাত্মিক যোগ রয়েছে।
‘লোককথা, ইতিহাস নয়’—গবেষকের মন্তব্য
রামনগরের শিক্ষক ও গবেষক তপন রঞ্জিত বলেন, “দেবী লঙ্কেশ্বরী সত্যিই লঙ্কা থেকে এসেছিলেন কি না, তার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সবটাই লোকমুখে প্রচলিত কাহিনি। তবে এই অঞ্চলের নদীপথ ও প্রাচীন বাণিজ্যিক যোগাযোগ দেখে অনুমান করা যায়, প্রাচীনকালে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত নৌযান চলাচল করত।”
তিনি জানান, একসময় রামনগর থেকে ওডিশার ভোগরাই পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা ‘বীরকুল’ নামে পরিচিত ছিল। সুবর্ণবেখা নদী থেকে বীরকুল নদীর সৃষ্টি হয়ে রামনগরের ভেতর দিয়ে সমুদ্রে মিশত। সেই নদীপথে বড় বড় বণিকজাহাজ যাতায়াত করত। বর্তমানে নদীটি খালে পরিণত হয়েছে, কিন্তু পুরোনো মানচিত্রে এর অস্তিত্বের উল্লেখ আছে।
তপন রঞ্জিত আরও বলেন, “এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবও একসময় প্রবল ছিল। তাই মূর্তির শিল্পরীতি ও নির্মাণশৈলীতে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রভাবের মিশেল দেখা যায়। পরীক্ষা ছাড়া মূর্তির প্রাচীনত্ব নির্ধারণ সম্ভব নয়, তবে এটি যে কয়েক শতাব্দী পুরোনো, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।”
পুরোহিত পরিবারের শতবর্ষের দায়িত্ব
বর্তমান পুরোহিত সর্বেশ্বর দাস জানান, “আমাদের পরিবার ১৯০৫ সাল থেকে দেবী লঙ্কেশ্বরীর পুজো করে আসছে। তার আগে বহু বছর ধরে পুজো করতেন পণ্ডা পরিবার। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমরা এই দেবীর সেবা করছি।”
তিনি হাসিমুখে যোগ করেন, “কিংবদন্তি ঠিক না ভুল, তা আমরা জানি না। কিন্তু এই দেবীর সঙ্গে মানুষের অগাধ বিশ্বাস জড়িয়ে আছে। আজও অনেকেই বিশ্বাস করেন, তিনি আসলেই লঙ্কার অধিষ্ঠাত্রী দেবী, যিনি বাংলার মাটিতে এসে মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করেছেন।”
দেবীর অলৌকিক জাগরণে স্থানীয় আস্থা
মীরগোদার মানুষদের মধ্যে প্রচলিত আছে, দেবী লঙ্কেশ্বরী মানত নিলে পূর্ণ করেন। গ্রামের কারও অসুখ, বিপদ বা আর্থিক সংকট দেখা দিলে মানুষ ভিড় জমায় মন্দিরে। বিশেষত পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় এখানে আয়োজন হয় বিশেষ পুজোর, যেখানে আশেপাশের গ্রামের মানুষও উপস্থিত থাকেন।
দিঘার পর্যটকরাও এখন এই মন্দির দেখতে আসেন। অনেকেই বলেন, “মন্দিরে পা রাখলেই এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব হয়। দেবীর মুখে যে শান্ত ভাব, তা চোখ সরাতে দেয় না।”
বিশ্বাসের মন্দিরে ইতিহাসের ছায়া
লঙ্কেশ্বরী মন্দির আজ শুধু এক ধর্মীয় স্থান নয়—এটি এক লোকবিশ্বাস, ইতিহাস ও ভক্তির মিলনস্থল। ইতিহাস যতই অস্পষ্ট হোক, দেবীর অস্তিত্ব ও জাগরণে মানুষের অটুট বিশ্বাসই প্রমাণ করে, এই দেবী মীরগোদার মানুষের হৃদয়ে আজও তেমনি জীবন্ত।
দেবীর ভাঙা হাত যেন হয়ে উঠেছে অটল ভক্তির প্রতীক—যা সময়ের আঘাতেও ভাঙেনি, কেবল আরও দৃঢ় হয়েছে।
