দশমীর পর থেকে টানা বৃষ্টি পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ফের বন্যার আশঙ্কা তৈরি করেছে। কখনও হালকা, কখনও ঝিরঝিরে, আবার কখনও অতি বৃষ্টি—সব মিলিয়ে কেলেঘাই নদীর দুই তীরে থাকা গ্রামগুলিতে এখন জলমগ্ন হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রবিবার থেকে নদীর জলস্তর দ্রুত বাড়ছে। সোমবার তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৮৪ মিটার, যেখানে চূড়ান্ত বিপদসীমা ৬.০৪ মিটার। অর্থাৎ এখনই মাত্র ২০ সেন্টিমিটার কম, আর সামান্য বৃষ্টি হলেই বিপর্যয় নেমে আসতে পারে দুই মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায়।
ভগবানপুর, পটাশপুর ও সবংয়ে বাড়ছে আশঙ্কা
পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুর ও পটাশপুর ব্লক, আর পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং ব্লক—এই তিন জায়গায় পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, টানা বৃষ্টি আর বেহাল নিকাশি ব্যবস্থার কারণে অনেক গ্রামে ইতিমধ্যে জল জমে রয়েছে।
এক বাসিন্দা বলেন,
“আর দু’দিন বৃষ্টি চললে মাঠের ধান ভেসে যাবে। জল বেরোনোর পথ নেই।”
বিশেষ করে ভগবানপুর, কোটবাড়, ভূপতিনগরের মতো এলাকায় নিকাশি খাল ভরাট ও জবরদখল হয়ে যাওয়ায় জমা জল নামছে না। কৃষকরা বলছেন, যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হবে।
নদীর উৎস থেকে উপচে পড়ছে জল
কেলেঘাই নদীর উৎপত্তি ঝাড়গ্রাম জেলায়। সেখানে এবং সংলগ্ন দুই মেদিনীপুর জেলায় লাগাতার বৃষ্টির ফলে পাহাড়ি ঢল নেমে নদীতে জল প্রবাহ বেড়েছে। এর ফলে দীর্ঘ কয়েক কিলোমিটার জুড়ে নদীর দুই তীরে থাকা গ্রাম ও মাঠ এখন বিপদের মুখে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আমগাছিয়া গ্রামের নিচু এলাকায় ইতিমধ্যেই নদীর জল ঢুকতে শুরু করেছে। বাগুই নদীর জলও একসঙ্গে বাড়ছে, ফলে অনেক জায়গায় সাঁকো ও রাস্তাঘাট ডুবে গেছে।
কাঠের সেতু জলের তলায়, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ
সবচেয়ে বিপদজনক অবস্থা পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ের লাঙলকাটা এলাকায়। কেলেঘাই নদীর উপরে থাকা কাঠের সেতুটি নদীর ফুলে ওঠা জলে সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। ফলে পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরের সঙ্গে সবংয়ের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
এখন সেই সংযোগের একমাত্র ভরসা ভুটভুটি (ইঞ্জিনচালিত নৌকা)। স্থানীয়রা বলছেন, আরও জল বাড়লে জগন্নাথচক, লেজিবেড়ি, মোগলানিচকসহ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হতে পারে।
প্রশাসনের আশ্বাস: নজরদারি ও মেরামতির কাজ চলছে
পটাশপুর-১ ব্লকের বিডিও শান্ত চক্রবর্তী বলেন,
“রবিবার থেকে জলস্তর কিছুটা বেড়েছে ঠিকই, তবে পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে। বাঁধের দুর্বল অংশগুলো মেরামতের কাজ চলছে। সেচ দপ্তরের কর্মীরা ২৪ ঘণ্টা নজর রাখছেন।”
ভগবানপুরের বিধায়ক রবীন্দ্র নাথ মাইতি এর কারণ হিসেবে বলেছেন,
“নিকাশি খাল দখল হয়ে যাওয়া ও বহু বছর সংস্কার না হওয়ার কারণে জল বেরোতে পারছে না। সেই কারণেই সমস্যার মাত্রা বাড়ছে।”
অন্যদিকে, জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ আবু কালাম বক্স জানিয়েছেন,
“রাতের দিকে জল আরও বাড়লে মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। রেসকিউ সেন্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে।”
প্রশাসনের সতর্কতা, আতঙ্কে সাধারণ মানুষ
জলবায়ু দপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় আরও বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসন ও সেচ দপ্তর সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছে।
তবুও এলাকার মানুষ এখন আশঙ্কা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ জমির ধান বাঁচানোর চেষ্টা করছেন, কেউ বা নদীর পাড়ে রাত জেগে জলস্তর মাপছেন।
পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের মানুষদের কাছে কেলেঘাই নদী যেমন জীবিকার উৎস, তেমনি ভয়ও। এবারের টানা বর্ষণে আবারও সেই ভয় ফিরে এসেছে।
চূড়ান্ত বিপদসীমার কেবল এক ধাপ নিচে নদীর জল দাঁড়িয়ে আছে—এমন অবস্থায় প্রশাসনের ক্ষণিকের ত্রুটিতেই ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
