পুজোর আগে যেমন, পুজোর পরেও ঘাটালে পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি। বৃষ্টি নামলেই যেন বুক কাঁপে মানুষের—কোন মুহূর্তে নদীর জল গ্রামে ঢুকে ঘরবাড়ি, ফসল, রাস্তাঘাট সব তলিয়ে দেবে কে জানে! শিলাবতী ও রূপনারায়ণ নদীর জলস্তর বাড়লেই ভয় ফিরে আসে ঘাটালবাসীর মনে।
তবে আশার আলোও দেখা যাচ্ছে। বহু প্রতীক্ষিত ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যানের প্রথম ধাপ এখন শেষের পথে। সেচ দপ্তরের তত্ত্বাবধানে নির্মিত পাঁচটি স্লুইসগেটের কাজ প্রায় শেষ, যা সম্পূর্ণ হলে এই অঞ্চলের বন্যা ও জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা প্রশাসনের।
বৃষ্টির ধাক্কায় সাময়িক ব্যাঘাত, ফের জোর গতিতে কাজ
প্রথম ধাপের কাজের মূল অংশ এখন শেষের দিকে। টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে কাজ কিছুটা ব্যাহত হলেও, সেচ দপ্তরের কর্মীরা ফের দ্রুতগতিতে কাজ শুরু করেছেন। নদীর পাড়ে এখন প্রায় দিনরাত চলছে নির্মাণ, মাটি কাটার, বাঁধ মজবুত করার কাজ।
দপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, কাজ এগোলেও পুরো প্রকল্প কার্যকর হতে হলে লাগোয়া নিকাশিনালাগুলির নির্মাণ ও সংযোগের কাজ শেষ করতেই হবে। সেগুলোর কাজ এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। ফলে যদি হঠাৎ ভারী বৃষ্টি হয়, নতুন তৈরি স্লুইসগেটগুলোও আপাতত পুরোপুরি জল আটকাতে পারবে না।
গোবিন্দপুর থেকে কৈজুরী—পাঁচটি স্লুইসগেটের বিশদ বিবরণ
সেচ দপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, ঘাটালের গোবিন্দপুর–কাটানে শিলাবতী নদীর উপর একটি বড় স্লুইসগেট তৈরি হয়েছে। এর পাশাপাশি দাসপুরের কৈজুরী, কুমারচক, রানিচক ও জ্যোতকানুরামগড় অঞ্চলে রূপনারায়ণ নদীর উপর আরও চারটি স্লুইসগেট নির্মিত হয়েছে।
প্রতিটি গেটের নির্দিষ্ট জলধারণ ও নিষ্কাশন ক্ষমতা রয়েছে।
- গোবিন্দপুরের স্লুইসগেট চালু হলে ঘাটাল পুরসভার প্রায় ৬০০ হেক্টর জমির জলমগ্নতা কমবে।
- দাসপুরের কৈজুরী এলাকায় চেতুয়া সার্কিট বাঁধের ওপর নির্মিত তিন ফোকরযুক্ত স্লুইসগেট চালু হলে ৭৫০ হেক্টর জমি জলমুক্ত হবে।
- কুমারচকে একই আকারের গেটের ফলে ৫৫০ হেক্টর জমি মুক্ত হবে বন্যার জল থেকে।
- আর রানিচক ও জ্যোতকানুরামগড়ে তৈরি চার ফোকরযুক্ত দুটি স্লুইসগেট কার্যকর হলে জলমুক্ত হবে যথাক্রমে ৩,৫০০ হেক্টর ও ২,০০০ হেক্টর জমি।
সব মিলিয়ে, এই পাঁচটি স্লুইসগেট ঘাটাল ও দাসপুরের কৃষি অঞ্চলগুলোতে দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতার সমস্যা কমিয়ে আনতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রকল্পে রাজ্যের ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ
ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যানের প্রথম ধাপের জন্য রাজ্য সরকার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। সেই অর্থের একটি বড় অংশ এই পাঁচটি স্লুইসগেট তৈরিতে ব্যয় হয়েছে। পাশাপাশি, নির্মিত হচ্ছে দুটি পাম্পহাউস, যা ভবিষ্যতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।
সেচ দপ্তরের সাব-কমিটির সদস্য আশিস হুদাইত বলেন,
“এই প্রকল্প পুরোপুরি চালু হলে কৃষকদের জন্য বিশাল সুবিধা হবে। তারা এখন শুধু বৃষ্টির জলেই নির্ভর করেন না, বরং গেট ও পাম্পের মাধ্যমে জল আটকে রেখে সেচের কাজে ব্যবহার করতে পারবেন।”
২০২৭ সালের আগেই কাজ শেষের আশাবাদ
ঘাটালের মহকুমাশাসক সুমন বিশ্বাস জানান,
“মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। সাময়িকভাবে মানুষ কিছু সমস্যায় পড়লেও আমরা আশাবাদী, ২০২৭ সালের আগেই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো শেষ করা সম্ভব হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এই স্লুইসগেটগুলো চালু হলে শুধু ঘাটাল নয়, আশপাশের দাসপুর ও চন্দ্রকোনা অঞ্চলেও বন্যার ভয় অনেকটা কমবে। কৃষকরা নিশ্চিন্তে চাষাবাদ করতে পারবেন, রাস্তা-ঘাটও থাকবে চলাচলের উপযোগী।”
বৃষ্টিতে ফের শিলাবতীর হুঙ্কার, কিন্তু আশার আলোও জ্বলছে
সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে ফের শিলাবতী নদীর জলস্তর বেড়েছে। কোথাও কোথাও ভাঙা বাঁধ দিয়ে জল ঢুকে পড়েছে গ্রামে। তবে সেচ দপ্তর আশাবাদী, নতুন স্লুইসগেটগুলো পুরোপুরি চালু হলে এমন দৃশ্য অনেকটাই অতীত হয়ে যাবে।
এখন ঘাটালের মানুষ অপেক্ষায়—কবে পুরো ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান কার্যকর হবে, কবে তারা মুক্তি পাবে বারবারের এই জলযন্ত্রণার হাত থেকে।
