রানিগঞ্জ থেকে কুলটি— পশ্চিমবঙ্গের ১৯ নম্বর জাতীয় সড়কের এই অংশটি এখন ট্রাকচালকদের কাছে আতঙ্কের নাম। পণ্যবাহী ট্রাকগুলিকে ঘিরে বারবার উঠছে তোলাবাজি ও পুলিশি দুর্নীতির অভিযোগ। বিশেষত কুলটির ডুবুরডিহি চেকপোস্ট এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে ‘প্যাড সিন্ডিকেট’ নামে এক রহস্যজনক চক্র, যারা অবৈধভাবে ট্রাক থেকে টাকা আদায় করছে বলে অভিযোগ। প্রশাসনের আশ্বাস থাকলেও, মাঠপর্যায়ে পরিস্থিতি অপরিবর্তিত বলেই জানাচ্ছেন চালক ও পরিবহণ মহল।
সম্প্রতি মুরগি বোঝাই একটি ট্রাক থামিয়ে টাকা দাবি করার অভিযোগে রানিগঞ্জ থানার এক অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টর (এএসআই) ও এক কনস্টেবলকে সাসপেন্ড করেছে পুলিশ। একই সঙ্গে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে দু’জন সিভিক ভলান্টিয়ারকেও। আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের ডিসি (সেন্ট্রাল) ধ্রুব দাস জানিয়েছেন, অভিযোগ পেয়েই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং তদন্তও চলছে। কিন্তু স্থানীয় ট্রাকচালকদের দাবি, এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়— বহু দিন ধরেই ‘প্যাড সিন্ডিকেট’-এর নামে এই রংদারি চলছে প্রশাসনের নাকের ডগায়।
মাঝরাতের বালির ট্রাক ও ১০ হাজার টাকার দাবি
গত ৩ অক্টোবর মাঝরাতে কুলটির ডুবুরডিহি চেকপোস্ট এলাকায় ঘটে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। ঝাড়খণ্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গের দিকে আসা বালি বোঝাই ১০টি ট্রাককে কয়েকজন যুবক রাস্তায় আটকে দেয়। অভিযোগ, প্রত্যেক ট্রাকচালকের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা করে ‘রংদারি’ দাবি করা হয়। চালকরা প্রশ্ন তোলেন, সমস্ত বৈধ চালান ও নথিপত্র সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও কেন দিতে হবে টাকা?
পরদিন সকাল থেকেই ক্ষুব্ধ ট্রাকচালকেরা জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাঁদের অভিযোগ, চেকপোস্টের কাছে স্থানীয় কিছু যুবক ডান্ডা হাতে দাঁড়িয়ে ভয় দেখিয়ে টাকা তোলে। ওভারলোডের অজুহাতে বিপুল অঙ্ক দাবি করা হচ্ছে। “পুলিশকে জানানো সত্ত্বেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি,” অভিযোগ বিক্ষুব্ধ চালকদের। তাঁদের মতে, এই অবৈধ রংদারির সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল এবং কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ সদস্য জড়িত।
‘প্যাড সিন্ডিকেট’ আসলে কীভাবে কাজ করে
তদন্তে উঠে এসেছে আরও অস্বস্তিকর তথ্য। পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খণ্ড সীমান্ত ঘেঁষা শিল্পাঞ্চলে অবৈধ কয়লা ও বালির ব্যবসা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। সেই সব ট্রাক যাতে বাধাহীনভাবে চলতে পারে, তার জন্য তৈরি হয়েছে তথাকথিত ‘প্যাড সিন্ডিকেট’।
চালকদের দাবি, এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নিয়ে বিশেষ ‘প্যাড কাগজ’ দেয়— যেখানে কারও নামের আদ্যাক্ষর ও নির্দিষ্ট টাকার অঙ্ক উল্লেখ থাকে। সেই কাগজ ট্রাকে লাগিয়ে বা সঙ্গে রাখলেই, পুলিশ বা স্থানীয় নেতা-অনুগামীরা আর বাধা দেয় না। অর্থাৎ, ওই কাগজ হয়ে উঠেছে একপ্রকার অঘোষিত পারমিট, যার বিনিময়ে প্রশাসনের নজর এড়িয়ে চলে অবৈধ কয়লা ও বালির ট্রাক।
আরটিও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ
এই চেকপোস্ট এলাকা শুধু পুলিশ নয়, আরটিও কর্মীদের বিরুদ্ধেও বিতর্কে জড়িয়েছে। এক ট্রাকচালক অভিযোগ করেছেন, তাঁর কাছ থেকে প্রথমে ৩০ হাজার, পরে আরও দু’হাজার টাকা জোর করে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে ২২ আগস্ট আটজন পরিবহণ আধিকারিক ও কর্মীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। এখন পর্যন্ত সেই মামলার অগ্রগতি নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনও বিস্তারিত তথ্য জানানো হয়নি।
প্রশাসনের বক্তব্য ও বাস্তব চিত্র
আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের ডেপুটি কমিশনার (ট্র্যাফিক) বিজি সতীশ বলেন, “আমরা কোনও তোলাবাজি বা বেআইনি টাকা আদায়ের অভিযোগ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত শুরু করি। রানিগঞ্জ ও কাল্লা এলাকার দুটি ঘটনায় তদন্ত হয়েছে।” তিনি আরও জানান, “ট্র্যাফিক পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ারদের সচেতন করতে নিয়মিত ওয়ার্কশপ ও আলোচনার আয়োজন করা হয়, যাতে কেউ এই ধরনের কাজে যুক্ত না হয়।”
তবে চালক ও পরিবহণ মহলের অভিযোগ, প্রশাসনিক তৎপরতা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। তদন্ত হয়, কিন্তু দোষীদের বিরুদ্ধে স্থায়ী শাস্তি দেখা যায় না। ফলে সাহস বেড়েছে বেআইনি চক্রগুলির।
ট্রাক মালিকদের কণ্ঠে বাস্তবতা
বর্তমানে আসানসোলে আগের মতো সক্রিয় ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন নেই। তবু কিছু মালিক জানিয়েছেন, শহরের ভেতর দিয়ে এখন কম ট্রাক চলে, তাই হয়রানি তুলনামূলক কম। নিয়ামতপুর ট্রাক ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক অশোক বিশ্বাসের বক্তব্য, “এখন আসানসোল শহরে পুলিশের দিক থেকে বড় কোনও উৎপাত নেই বললেই চলে।”
তবুও সীমান্তবর্তী চেকপোস্ট এলাকাগুলিতে যে ‘প্যাড সিন্ডিকেট’-এর দৌরাত্ম্য অব্যাহত, তা চালকদের অভিজ্ঞতা থেকেই স্পষ্ট। শিল্পাঞ্চলের প্রাণরেখা এই মহাসড়কেই যদি আইনহীনতার ছায়া ঘনিয়ে আসে, তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়— রংদারির এই সিন্ডিকেটের লাগাম কে টানবে?
