বড় ধরনের আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে আসানসোল পুরসভা। কর আদায়ের ক্ষেত্রে রেল, কয়লাখনি ও ইস্পাত কারখানার মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরশীল এই পুরসভা সম্প্রতি তার অন্যতম প্রধান করদাতা ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি (ইস্কো)-র কাছে ১৭ কোটিরও বেশি টাকা বকেয়া দাবি করেছে।
পুরসভা সূত্রে জানা গেছে, সোমবার বার্নপুরে অবস্থিত ইস্কো কারখানার ডিরেক্টর ইনচার্জকে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে জানানো হয়, কর ও সার্ভিস চার্জ বাবদ ইস্কোর কাছে বর্তমানে ১৭ কোটি ৭৮ লক্ষ ২৫ হাজার ৮৫৪ টাকা বকেয়া রয়েছে। চিঠিতে অনুরোধ করা হয়েছে, “বর্তমান আর্থিক সঙ্কটের কারণে অনতিবিলম্বে এই পাওনাটির নিষ্পত্তি করা জরুরি।”
কোথায় কত বকেয়া
পুরসভার কর বিভাগের তথ্যানুসারে, ইস্কোর মোট ১০টি হোল্ডিং নম্বর রয়েছে বার্নপুর সংলগ্ন এলাকায়—ছোট দিঘারি, নরসিংবাদ, গারুই, গোপালপুর, নবঘণ্টি, কুমারপুর, সাঁতাডাঙ্গা ও নরসমুদারসহ আরও কয়েকটি স্থানে। এসব হোল্ডিং মিলিয়ে পুরসভা ইস্কোর কাছে ১২ কোটি ৬৭ লক্ষ ২৬ হাজার ৯৫৪ টাকা কর বাবদ দাবি করছে।
এর সঙ্গে চলতি অর্থবছরের (২০২৫-২৬) প্রায় ৫ কোটি টাকা বকেয়া যুক্ত হয়ে মোট পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ কোটি টাকা। পুরসভার ট্যাক্স ইনচার্জ জানিয়েছেন, “পুরসভার আর্থিক স্থিতি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। তাই কর প্রদানে গাফিলতি চলবে না—ইস্কো কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ করা হয়েছে।”
চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়েছে পুরসভার মেয়র, কমিশনার এবং ইস্কোর অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছেও।
ইস্কোর অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া
এ বিষয়ে ইস্কোর জনসংযোগ কর্মকর্তা ভাস্কর কুমার বলেন, “চিঠিটি আজই এসেছে, আমি এখনো বিস্তারিত দেখিনি। আগামীকাল বিষয়টি খতিয়ে দেখব। যেহেতু টাকার অঙ্কটা বেশ বড়, তাই না জেনে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।”
অন্যদিকে আসানসোল পুরসভার বার্নপুর এলাকার কাউন্সিলর ও তৃণমূল নেতা অশোক রুদ্র বলেন, “২০১৭ সাল থেকেই ইস্কোর কাছে সার্ভিস ট্যাক্স বকেয়া পড়ে আছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের পুরো টাকাই এখনো পরিশোধ করা হয়নি। এর আগেও পুরসভা তাদের কিছু অংশ কর মকুব করেছিল, কিন্তু তার পরও বকেয়া পরিশোধ করা হয়নি।”
কর মকুব ও লিজ বিতর্ক
পুরসভা সূত্রে জানা গেছে, অতীতে ইস্কোকে কিছু ক্ষেত্রে কর ছাড় দেওয়া হয়েছিল, যাতে তারা স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে পুরসভা সেই সহায়তা পায়নি বলেই অভিযোগ।
আরও বিতর্ক তৈরি হয়েছে ইস্কোর লিজ নীতিকে ঘিরে। আশ্চর্যের বিষয়, মাত্র এক টাকায় ৩৩ বছরের জন্য বার্নপুর ডাকঘরকে পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল ইস্কো। কিন্তু সম্প্রতি তারা ডাক বিভাগকে জানিয়েছে, সেই লিজ চার্জ এখন কোটি টাকার বেশি হয়েছে। একইভাবে বার্নপুর স্টেট ব্যাংক শাখার ক্ষেত্রেও কয়েক গুণ লিজ চার্জ বাড়ানো হয়েছে।
স্থানীয় নাগরিকদের প্রশ্ন, “যখন লিজ চার্জ বাড়াতে এত উদ্যোগ, তখন কেন পুরসভার বকেয়া আট বছর ধরে পরিশোধ করা হলো না?”
পুরসভার আর্থিক টানাপোড়েন
আসানসোল পুরসভার একাধিক কর কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরে রেল ও কয়লাখনি খাতে কর আদায়ও কমে গেছে। ইস্কোর মতো বড় করদাতাদের বকেয়া আদায় না হওয়ায় দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজ ও নাগরিক পরিষেবা—যেমন রাস্তা মেরামত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জল সরবরাহ—ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এক কর কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এখন পুরসভার আয় কমে অর্ধেকে নেমেছে। স্থায়ী করদাতারা সময়মতো কর দিলেও বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বকেয়া আদায় না হওয়ায় পুরো প্রশাসন বিপাকে পড়েছে।”
পরবর্তী পদক্ষেপ
পুরসভা জানিয়েছে, ইস্কোর কাছ থেকে বকেয়া আদায়ের জন্য প্রয়োজনে প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে মেয়রের সভাপতিত্বে এক বিশেষ বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।
শহরের বাসিন্দারা বলছেন, পুরসভা-ইস্কো টানাপোড়েনে যেন নাগরিক পরিষেবা বিঘ্নিত না হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলিও আহ্বান জানিয়েছে, দুই পক্ষ দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছাক।
আসানসোলের অর্থনীতিতে ইস্কোর ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি পুরসভার আর্থিক স্থিতি রক্ষার জন্য কর আদায়ও অপরিহার্য। দীর্ঘ আট বছর ধরে চলা বকেয়া বিতর্ক যদি দ্রুত নিষ্পত্তি না হয়, তাহলে এর প্রভাব পড়বে শহরের নাগরিক জীবন ও উন্নয়ন প্রকল্পের ওপর।
