কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি শিক্ষাকর্মীদের হাজিরা নীতিতে বড় পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। চলতি বছরের ১৪ জুলাই জারি হওয়া নতুন হাজিরা বিধি প্রত্যাহার করে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০০১ সালের সংশোধিত ছুটি ও উপস্থিতি সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্সই আবার কার্যকর করা হবে। তবে নতুন করে প্রকাশিত সার্কুলার ঘিরে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক, কারণ এতে শুধুমাত্র শিক্ষাকর্মীদের হাজিরা সংক্রান্ত নিয়মাবলি স্পষ্ট করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিকদের উপস্থিতি ও শৃঙ্খলার বিষয়ে একটিও বাক্য নেই।
ফলে আগামী সোমবার থেকে বিধিটি কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়টি ক্যাম্পাস মিলিয়ে হাজারেরও বেশি শিক্ষাকর্মী ক্ষোভে ফুঁসছেন।
হাজিরা বিধিতে একাধিক মানদণ্ড—‘দরজায় ঢোকার সময়েই বৈষম্য’ অভিযোগ কর্মীদের
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিনিয়র সুপারদের কাছে আগেই নির্দেশিকা পাঠিয়েছে। তাদের দায়িত্বই প্রতিটি সেকশনে হাজিরা খাতার রক্ষণাবেক্ষণ ও কর্মীদের আগমন-বহির্গমন পর্যবেক্ষণ। নিয়ম অনুযায়ী অফিস সময় সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা। কলেজ স্ট্রিটসহ সব ক্যাম্পাসেই একই সময়সীমা বলবৎ হবে।
২০০১ সালের বিধি অনুসারে সওয়া ১০টার পরে প্রবেশ করলে ‘লেট মার্ক’ এবং পৌনে ১১টার পরে ঢুকলে ‘অ্যাবসেন্ট’ ধরা হত। কিন্তু নতুন নির্দেশে দেখা যাচ্ছে, কোথাও ১১টায় লেট মার্ক, আবার কোথাও একই সময়ে অ্যাবসেন্ট—বিভাগভেদে আলাদা আলাদা মানদণ্ড। এই বৈষম্যমূলক বিধিনিষেধকেই সবচেয়ে বড় সমস্যার জায়গা হিসেবে দেখছেন বহু কর্মচারী।
এক জন কর্মী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “কোনও বিভাগে ১১টায় লেট, অন্য বিভাগে একই সময়ে অ্যাবসেন্ট—এভাবে নিয়ম আলাদা হলে তা অন্যায়ই তো!”
অফিসারদের হাজিরা নিয়ে নীরবতা—কী বার্তা দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়?
হাজিরা সার্কুলারে আধিকারিকদের উপস্থিতি, আগমন-বহির্গমন সময় বা শৃঙ্খলা বিষয়ে একবারও উল্লেখ করা হয়নি। এই বিষয়টিকেই সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করছেন শিক্ষাকর্মীরা।
ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সভাপতি শুভেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন,
“এই সার্কুলার শুধুমাত্র শিক্ষাকর্মীদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর দায়িত্ব যে আধিকারিকদের ওপর, তাঁদের হাজিরা নিয়ে কোনও নির্দেশ নেই। সব ক্যাম্পাসে, সব বিভাগের জন্য একই বিধি প্রযোজ্য হোক—এটাই আমাদের দাবি।”
তিনি আরও জানান, বিভাগভেদে আলাদা নিয়ম থাকলে কর্মীদের মধ্যে বিভেদ, অসন্তোষ ও অনাস্থা তৈরি হবে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসংস্কৃতি উন্নয়নে সহায়ক নয়।
‘অনেকে সপ্তাহে একদিনও আসেন’—অভিযোগ শিক্ষাবন্ধু সমিতির
সারা বাংলা তৃণমূল শিক্ষাবন্ধু সমিতির কনভেনর প্রবীর ঘোষ আরও কঠোর মন্তব্য করেন। তাঁর অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু আধিকারিকই নিয়মিত সময়মতো ক্যাম্পাসে আসেন না। কেউ কেউ এতটাই দেরিতে পৌঁছন যে হাজিরা খাতায় সই করতেও ভয় পান। আবার কারও ক্ষেত্রে সপ্তাহে একদিনও উপস্থিত থাকা নিশ্চিত নয়।
তিনি বলেন,
“যাঁদের নেতৃত্বে কর্মসংস্কৃতি গড়ে ওঠার কথা, তাঁরাই যদি নিয়ম মানেন না—তাহলে কর্মীদের শাসন করে কী হবে?”
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি—অফিসারদেরও নিয়ম মানতেই হবে
অভিযোগের জবাবে ডেপুটি রেজিস্ট্রার (বিসিডব্লিউ) জ্যোতির্ময় রায় বলেন,
“আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও যান্ত্রিক হাজিরা পদ্ধতি নেই। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এখানে রেজিস্টার খাতাতেই সই করতে হয়—কর্মী হোন বা অফিসার। নিয়ম ভাঙলে লেট মার্ক বা অ্যাবসেন্ট দিতে সিনিয়র সুপাররাই দায়িত্বপ্রাপ্ত।”
তবে শিক্ষাকর্মীদের প্রশ্ন, যদি সত্যিই সবাই একই নিয়মের অধীন, তাহলে সার্কুলারে আধিকারিকদের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হল না কেন?
কর্মীদের দাবি—সমতা চাই, স্বচ্ছতা চাই
পোস্ট-সার্কুলার পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র একটাই দাবি—
একটি সার্বজনীন উপস্থিতি নীতি, যেখানে শিক্ষাকর্মী ও আধিকারিক উভয়েই একই বিধির অধীন থাকবেন, এবং কোনও বিভাগভিত্তিক বৈষম্য থাকবে না।
অনেকের মতে, উপস্থিতি-সংক্রান্ত শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা জরুরি হলেও তা একতরফা বা অসমভাবে প্রয়োগ হলে কর্মীদের মনোবলে আঘাত লাগে, এবং দৈনন্দিন প্রশাসনেও অস্বস্তির সৃষ্টি হয়।
সোমবার নতুন বিধি কার্যকর হওয়ার আগে পর্যন্তও প্রশ্ন রয়ে গেছে—
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজিরা সংস্কারে কি সত্যিই সমতা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে? নাকি শুধু শিক্ষাকর্মীদেরই টার্গেট করা হচ্ছে?

সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited