ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (Special Summary Revision — ‘সার’) শুরু হওয়ার আগেই দেশজুড়ে নির্বাচনী প্রস্তুতিতে দেখা দিয়েছে অস্বস্তির ছায়া। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, প্রশিক্ষণ শিবিরেই বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন বুথ লেভেল অফিসাররা (BLO)। তাঁদের অভিযোগ— সময়সীমা অবাস্তব, দায়িত্বের চাপ অমানবিক, আর সবচেয়ে বড় কথা— নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
আগামী ৪ নভেম্বর থেকে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে এনিউমারেশন ফর্ম বিলির কাজ শুরু হওয়ার কথা। তার আগে শনিবার কলকাতা ও বিভিন্ন জেলায় বিএলওদের প্রশিক্ষণ শিবির অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রশিক্ষণের পরিবেশেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন উপস্থিত কর্মকর্তারা, যাঁদের অধিকাংশই শিক্ষক-শিক্ষিকা।
ক্ষোভে ফেটে পড়া নজরুল মঞ্চ
খাস কলকাতার নজরুল মঞ্চে আলিপুর মহকুমাশাসকের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয় প্রশিক্ষণ। দুই পর্বে এই শিবিরে মোট প্রায় ১৮০০ জন BLO অংশ নেন। প্রশিক্ষণের শেষভাগেই একের পর এক প্রশ্নে মঞ্চ গর্জে ওঠে। অনেকেই দাঁড়িয়ে বলেন—
“আমরা দায়িত্ব নিচ্ছি, কিন্তু নিরাপত্তা আর বাস্তবসম্মত সময়সীমা না থাকলে কাজ হবে কীভাবে?”
অভিযোগ, প্রশিক্ষণ নিতে আসা BLOদের বেশিরভাগই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তাঁদের স্কুলের রোজকার কাজ শেষ করেই বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ফর্ম বিতরণ ও সংগ্রহ করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু বিকেল ৪টার পর এই দায়িত্ব পালন করা কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন।
যাদবপুর বিদ্যাপীঠের শিক্ষিকা জোনাকি ঘোষ ও নারকেলডাঙা হাইস্কুলের শিক্ষক দেবপ্রসাদ মজুমদারসহ অনেকেই জানিয়েছেন,
“একটি বুথে গড়ে ১২০০–১৪০০ জন ভোটার। প্রত্যেকের বাড়ি অন্তত একবার, অনুপস্থিত থাকলে তিনবার যেতে হবে। প্রতিবারে ন্যূনতম ৫–১০ মিনিট সময় লাগে। এই পরিস্থিতিতে স্কুলের দায়িত্ব পালন শেষে এত কাজ করা অসম্ভব।”
“রাত পর্যন্ত ফর্ম বিলি করতে হবে, কিন্তু নিরাপত্তা কে দেবে?”
বিশেষ উদ্বেগের বিষয় নিরাপত্তা। মহিলা BLOরা জানিয়েছেন, রাত পর্যন্ত মাঠে কাজ করলে তাঁদের শারীরিক নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
জোনাকি ঘোষের প্রশ্ন—
“রাত পর্যন্ত বাড়ি-বাড়ি ফর্ম বিলি করতে গেলে আমাদের নিরাপত্তা কে নিশ্চিত করবে? কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। কেন এমন ঝুঁকির মধ্যে আমাদের পাঠানো হচ্ছে?”
এমনকি রাজনৈতিক চাপের আশঙ্কাও তাঁরা তুলেছেন। বিভিন্ন জায়গায় শাসক ও বিরোধী দলের কর্মীদের পক্ষ থেকে BLOদের নাম করে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এলাকাগুলিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তা আগেভাগে না দেওয়ায় ক্ষোভ আরও বেড়েছে।
প্রশিক্ষণে প্রশাসনিক বিভ্রাট
প্রথম পর্বের প্রশিক্ষণ চলাকালীন BLOদের একাংশ প্রশ্ন তুলতেই দায়িত্বপ্রাপ্ত এসডিও মঞ্চ থেকে নেমে যান। এতে ক্ষোভ আরও বাড়ে। কেউ কেউ মঞ্চে উঠে প্রতিবাদ জানান—
“আমাদের প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত আমরা নড়ব না।”
শেষ পর্যন্ত এসডিও পরিস্থিতি শান্ত করতে বলেন, BLOদের অধিকাংশ প্রশ্নই যৌক্তিক, এবং সব দাবিদাওয়া তিনি মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিককে জানাবেন।
উত্তর কলকাতা ও জেলাগুলিতেও একই চিত্র
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরোজিও হলে উত্তর কলকাতার BLOদের প্রশিক্ষণেও উঠে আসে একই অসন্তোষ।
শিক্ষিকা সায়ন্তী সামন্ত বলেন,
“স্কুলের সিলেবাস শেষ করার দায়িত্বও আমার। এখন যদি সারাদিন পরে ফর্ম বিলি করতে হয়, সময় মিলবে কীভাবে?”
অন্যদিকে সোমা দত্ত, যিনি তাঁর স্কুলের হেড ক্লার্ক হিসেবেও দায়িত্বে আছেন, প্রশ্ন তোলেন—
“স্কুলে অডিট চলছে, আমাকেও থাকতে হচ্ছে। আবার ভোটার তালিকা সংশোধনের দায়িত্ব। দু’টো একসঙ্গে করা সম্ভব নয়।”
প্রশিক্ষণে উপস্থিত জেলা নির্বাচনী আধিকারিক তাঁদের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে পারেননি বলে জানা গেছে। একই ছবি ধরা পড়েছে হাওড়া, হুগলি, নদিয়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেও।
নিরাপত্তাহীনতায় দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি
ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় প্রায় শ’খানেক BLO দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কমিশনের শো–কজ বা সাসপেনশনের হুঁশিয়ারিতেও তাঁরা অনড়।
মূল কারণ— রাজনৈতিক চাপ ও নিরাপত্তা অনিশ্চয়তা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীর পক্ষ থেকে BLOদের নাম করে হুমকির ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ উঠছে।
কমিশনের নীরবতা ও আশঙ্কার ছায়া
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য মেলেনি। তবে কমিশন নিজেও চিন্তিত— এত চাপের মধ্যে ‘সার’–এর কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করা আদৌ সম্ভব হবে কি না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ ধাক্কা খেতে পারে, যা ভবিষ্যতের নির্বাচনী সূচিতেও প্রভাব ফেলবে।
BLOরা দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর— মাঠপর্যায়ের প্রকৃত কর্মী। তাঁদের উদ্বেগ, নিরাপত্তা ও সময়সংকটের প্রশ্নগুলো যদি অবহেলিত থাকে, তবে শুধু প্রশাসনিক নয়, নৈতিক সংকটও তৈরি হবে নির্বাচন কমিশনের সামনে।
ভোটের প্রক্রিয়া যেন কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য থাকে, তার জন্য এখন একটাই প্রয়োজন— মাঠপর্যায়ের কর্মীদের পাশে কমিশনের দৃশ্যমান সহমর্মিতা ও বাস্তবসম্মত সমাধান।

সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited