পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেকটি অধ্যায় যোগ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার (২৭ অক্টোবর) তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৪ বছর ১৬০ দিন পূর্ণ করেছেন, যা বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের ১৪ বছর ১৫৯ দিনের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। এর মাধ্যমে মমতা এখন রাজ্যের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সময় ধরে দায়িত্বে থাকা মুখ্যমন্ত্রী।
বাংলার ইতিহাসে মুখ্যমন্ত্রিত্বের সর্বাধিক সময়ের রেকর্ড রয়েছে প্রয়াত জ্যোতি বসুর, যিনি টানা ২৩ বছর ৫ দিন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সেই তুলনায় মমতা এখনও অনেক পথ বাকি থাকলেও, তাঁর এই সাফল্যকে তৃণমূল কংগ্রেস ‘ঐতিহাসিক’ বলে উল্লেখ করেছে। দলীয় নেতারা সামাজিক মাধ্যমে অভিনন্দন জানিয়েছেন ‘দিদিকে’— রাজ্যের নেতৃত্বে তাঁর দীর্ঘ যাত্রার জন্য।
বিধানচন্দ্র থেকে মমতা: এক ঐতিহাসিক তুলনা
বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম প্রজন্মের রাজনীতিকদের একজন, যিনি চিকিৎসক হিসেবে যেমন খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নে রেখেছিলেন স্থায়ী ছাপ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্যদিকে, তিন দশকেরও বেশি সময়ের রাজনৈতিক লড়াই শেষে ২০১১ সালে বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসন শেষ করে বাংলার প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাস গড়েন।
এই ১৪ বছরেরও বেশি সময়ে মমতা প্রশাসন নানা সামাজিক প্রকল্প— যেমন “কন্যাশ্রী”, “রূপশ্রী”, “লক্ষ্মীর ভান্ডার”, “স্বাস্থ্যসাথী”— চালু করে প্রশংসা পেয়েছে। রাজনৈতিকভাবে তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসও এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে অবস্থান পাকা করেছে।
ছটপুজো উপলক্ষে গঙ্গার ঘাটে মমতা: নিরাপত্তায় বিশেষ নজর
নতুন রেকর্ডের দিনটিতে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জনতার মাঝে। সোমবার সকালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার গঙ্গার তক্তাঘাট ও দইঘাটে ছটপুজোর প্রস্তুতি দেখতে যান। দইঘাটে তিনি নবনির্মিত হনুমান মন্দিরের সংস্কার শেষে উদ্বোধন করেন— যা গত বছর তাঁর নির্দেশে সংস্কার করা হয়েছিল।
গঙ্গার ঘাটে ভক্তদের বিপুল ভিড়ের কথা মাথায় রেখে মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনকে নির্দেশ দেন—
“একটি টিমের পূজা হয়ে গেলে আরেকটি টিম যেন পূজা করে। সবাই একসঙ্গে নেমে গেলে পদপিষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কেউ চিৎকার করলে ভয় পাবেন না— ভিড়ের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো বিপজ্জনক।”
তিনি আরও বলেন, উৎসবের সময় মহিলা ও শিশুদের নিরাপত্তায় বাড়তি নজর দিতে হবে। কারণ, উৎসবের ভিড়ের মধ্যে কিছু অসৎ ব্যক্তি সুযোগ নিতে পারে। মমতা প্রশাসন ও পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলেন, যেন “ছটপুজো ছাড়া অন্য কোনো প্রচেষ্টা সফল না হয়।”
এ সময় উপস্থিত ছিলেন কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম, পুলিশ কমিশনার মনোজ ভার্মা, এবং প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
তৃণমূলের শুভেচ্ছা বার্তা ও জনমত
মমতার মুখ্যমন্ত্রিত্বের এই নতুন অধ্যায়কে ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছে। তৃণমূলের নেতারা বলেন, “বাংলার মেয়ে আজ ইতিহাস গড়েছেন।” অনেকে মন্তব্য করেছেন— “মমতা শুধু রাজনীতি নয়, বাংলার জনজীবনের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মমতার নেতৃত্বে তৃণমূলের টানা তিনবারের বিজয় তাঁর জনপ্রিয়তারই প্রমাণ। তবে সামনে আরও চ্যালেঞ্জ— প্রশাসনিক সাফল্যের ধারাকে ধরে রেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থায়ী উত্তরাধিকার তৈরি করা।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্ব এখন কেবল সময়ের হিসেবে নয়, রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা ও নেতৃত্বের স্থায়িত্বের প্রতীক। বিধানচন্দ্র রায়ের রেকর্ড ভেঙে তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে নিজের নাম আরও উজ্জ্বলভাবে লিখে রাখলেন।
তবে তাঁর নিজের ভাষায়— “রেকর্ডের চেয়ে বড় বিষয় মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা, সেটাই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।”
সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited