কলকাতা মহানগরীর দুটি ঐতিহাসিক জলাশয়—রবীন্দ্র সরোবর ও সুভাষ সরোবর—এই বছর ছট পূজার দূষণ থেকে রক্ষা পেয়েছে। প্রশাসনের কঠোর নজরদারি ও আদালতের নির্দেশ মান্য করে এবার এই দুই সরোবরের ভেতরে কোনো পূজা অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে, বহু বছরের পর এই দুই জলাশয় দূষণমুক্ত থাকল বলে জানাচ্ছেন পরিবেশকর্মীরা।
তবে শহরের অন্যান্য এলাকায় ছট উপলক্ষে জলাশয় দূষণ ও বাজি পোড়ানো রোধে প্রশাসন তেমন সফল হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও কালীপূজা ও দিওয়ালির তুলনায় এবার বাজি পোড়ানোর পরিমাণ অনেকটাই কম ছিল, তবু পরিবেশকর্মীরা বলছেন—“দূষণ নিয়ন্ত্রণে আরও সচেতনতা ও পরিকল্পনা প্রয়োজন।”
আদালতের নির্দেশে সরোবর বন্ধ
জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ অনুসারে, রবিবার সকাল ১০টা থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত রবীন্দ্র সরোবর ও সুভাষ সরোবর সাধারণ মানুষের প্রবেশের জন্য পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়। রবীন্দ্র সরোবরের প্রতিটি গেটে মোতায়েন ছিল বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য, বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী এবং কেএমডিএ কর্মকর্তারা।
ফলে সোমবার ছট পূজার দিন হাতে গোনা কয়েকজন পূণ্যার্থী দুই সরোবর চত্বরে এলেও, নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁদের ভেতরে ঢুকতে দেননি। বরং, তাঁদের কাছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে লাগোয়া বিকল্প জলাশয়ে পূজা করার অনুরোধ জানানো হয়।
বিকল্প ঘাটে পূজা
পুণ্যার্থীদের অসুবিধা এড়াতে কেএমডিএ (কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) আগেই বিকল্প ঘাট প্রস্তুত রেখেছিল। রবীন্দ্র সরোবরের লাগোয়া ১৩টি এবং সুভাষ সরোবরের আশপাশে ১২টি বিকল্প ঘাটে পূজা সম্পন্ন হয়।
কেএমডিএর এক কর্মকর্তা জানান, “আমরা চাই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে হোক, তবে পরিবেশের ক্ষতি যেন না হয়। তাই বিকল্প জলাশয়ে নিরাপত্তা, আলো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।”
পরিবেশকর্মীদের সন্তুষ্টি
পরিবেশকর্মী সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় সকাল থেকেই রবীন্দ্র সরোবর চত্বরে অবস্থান করছিলেন। তিনি বলেন,
“প্রশাসনের কঠোর নিরাপত্তা ও সজাগ ভূমিকার কারণেই এবার সরোবরের মধ্যে কেউ ঢুকতে পারেননি। গতবার আমরা যেভাবে দূষণের পর জলজ প্রাণী ও পাখিদের ক্ষতি দেখেছিলাম, এবার তা হয়নি—এটা বড় সাফল্য।”
তিনি আরও বলেন, “সরোবরকে বাঁচাতে প্রশাসনের যে মনোযোগ দেখা গেছে, তা আগামী বছরও বজায় রাখা প্রয়োজন। একই সঙ্গে শহরের অন্য জলাশয়গুলোতেও এমন উদ্যোগ নেওয়া দরকার।”
দূষণ রোধে চ্যালেঞ্জ
যদিও রবীন্দ্র ও সুভাষ সরোবর দূষণ থেকে বাঁচানো গেছে, শহরের অন্যান্য অংশে ছট উপলক্ষে প্লাস্টিক, ফুল, ফল, ধূপকাঠি ও মাটির প্রদীপের বর্জ্যে জলাশয় দূষিত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
এক পরিবেশ পর্যবেক্ষক জানান, “ছটের মূল চেতনা প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা। কিন্তু আমরা যদি পূজার নামে প্রকৃতিকেই ক্ষতি করি, সেটি মূল ভাবনার পরিপন্থী। তাই শুধু আদালতের নির্দেশ নয়, সামাজিকভাবে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।”
বাজি ও শব্দ দূষণ কমলেও সতর্কতা অব্যাহত
কালীপূজা ও দিওয়ালির তুলনায় এবার বাজি পোড়ানো তুলনামূলকভাবে কম হলেও সোমবার গভীর রাতে ও মঙ্গলবার ভোরে কিছু এলাকায় বাজি ফাটানোর খবর পাওয়া গেছে। পরিবেশকর্মীরা বলছেন, শহরের কয়েকটি এলাকায় এখনো শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।
এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, “আমরা বিশেষ টহল ও নজরদারি রেখেছি। মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত দুই সরোবর চত্বরে কঠোর নজরদারি চলবে, যাতে কেউ পূজার নামে সেখানে প্রবেশ করতে না পারেন।”
সচেতনতার জয়
পরিবেশবিদরা মনে করছেন, আদালতের নির্দেশ এবং প্রশাসনের কঠোর মনোভাব এবার একটি ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে—ধর্মীয় উৎসব পালন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরস্পরের বিরোধী নয়।
পরিবেশবিদ অরূপ সেনগুপ্ত বলেন, “এটা শহরের জন্য এক বড় দৃষ্টান্ত। যদি আমরা প্রতিটি উৎসবে এমনভাবে দায়িত্বশীল আচরণ করি, তাহলে আমাদের নগর পরিবেশ আবারও প্রাণ ফিরে পাবে।”
সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited