রাজ্যের পুরসভাগুলির বেহিসেবি খরচের লাগাম টানতে অবশেষে কঠোর পদক্ষেপ নিল নবান্ন। রাজ্য পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তর স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে—সরকারি অনুমোদন ছাড়া কোনও পুরসভা ৪৫ লক্ষ টাকার বেশি মূল্যের কাজের বরাত (ওয়ার্ক অর্ডার) ইস্যু করতে পারবে না। কেউ নিয়ম ভেঙে খরচ করলে তার দায় সম্পূর্ণ পুরসভাকেই বহন করতে হবে; রাজ্য সরকার কোনোভাবেই সেই ব্যয়ভার নেবে না।
এই নির্দেশের ফলে কার্যত পুরসভাগুলির স্বাধীন খরচে নেমে এসেছে কঠোর নিয়ন্ত্রণ। পুরসভাগুলির আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এই পদক্ষেপকে ‘অত্যন্ত প্রয়োজনীয়’ বলেই মনে করছেন প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
‘পোস্ট ফ্যাক্টো স্যাংশন’ বন্ধে কড়াকড়ি
রাজ্য সরকারের সূত্রে জানা গিয়েছে, পুরসভাগুলির অনেকেই এতদিন নিয়ম ভেঙে খরচ করছিল। নির্দিষ্ট সীমার বাইরে গিয়ে কাজের বরাত দিচ্ছিল, পরে পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরের কাছ থেকে অনুমোদন চাইত—যা প্রশাসনিক পরিভাষায় ‘পোস্ট ফ্যাক্টো স্যাংশন’ নামে পরিচিত।
সরকারের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এই পদ্ধতির অপব্যবহারই পুরসভাগুলির বেহিসেবি খরচের অন্যতম কারণ। অনুমোদন ছাড়া কোটি টাকার কাজের বরাত দেওয়ার পর, পরবর্তীতে অনুমোদনের আবেদন জানানোয় আর্থিক ভার বাড়ছিল রাজ্য সরকারের ঘাড়ে।
ফলে নবান্ন এবার সাফ জানিয়ে দিয়েছে—পোস্ট ফ্যাক্টো স্যাংশনের যুগ শেষ। আগাম অনুমোদন না থাকলে কোনও অতিরিক্ত খরচের টাকা আর দেবে না রাজ্য।
খরচের সীমা বেঁধে দিয়েছে সরকার
রাজ্য অর্থ দপ্তর ইতিমধ্যে খরচের ক্ষমতার সীমা স্পষ্ট করেছে।
- পুরসভার চেয়ারম্যান নিজে সর্বোচ্চ ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচের অনুমোদন দিতে পারেন।
- চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিল সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচের অনুমোদন দিতে পারে।
- আর বোর্ড অফ কাউন্সিল সর্বোচ্চ ৪৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচের অনুমোদন দিতে পারে।
এর বাইরে কোনও কাজের বরাত দিতে হলে আগাম অনুমোদন লাগবে রাজ্য দপ্তরের।
কিন্তু বাস্তবে বহু পুরসভাই এই সীমা অমান্য করছে বলে অভিযোগ। অনুমোদন ছাড়াই ওয়ার্ক অর্ডার ইস্যু করছে, পরে অনুমোদনের আবেদন জানাচ্ছে। এতে সরকারের উপর আর্থিক চাপ ক্রমেই বাড়ছে।
পুরসভাগুলির যুক্তি: ‘জরুরি কাজ থমকে যাবে’
তবে রাজ্যের বিভিন্ন পুরসভার চেয়ারম্যানদের মতে, এই নতুন নির্দেশে বিপাকে পড়বে স্থানীয় প্রশাসন। অনেক সময় জরুরি পরিস্থিতিতে (যেমন জল সরবরাহ, নিকাশি ব্যবস্থা, বা রাস্তা মেরামত) তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
উত্তর ২৪ পরগনার এক পুরসভা চেয়ারম্যান বলেন,
“অনেক সময় জরুরি ভিত্তিতে কাজ করতে গিয়ে পুর দপ্তরের অনুমোদন নেওয়ার মতো সময় পাওয়া যায় না। আগে কাজটা করতে হয়, পরে অনুমোদন চাইতে হয়। এখন যদি পোস্ট ফ্যাক্টো স্যাংশনই বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে বহু জরুরি কাজ থেমে যাবে।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে গেলে প্রচুর সময় লাগে। বিভিন্ন নথি, হিসাব, কৈফিয়ত দিতে হয়। এই জটিল প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।”
চেয়ারম্যানরা জানিয়েছেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের পুরমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
সরকারের অবস্থান: আর্থিক শৃঙ্খলা অটুট রাখতে হবে
অন্যদিকে নবান্নের কর্মকর্তারা বলছেন, “রাজ্যের রাজস্ব আয় সীমিত। প্রতিটি টাকা হিসেবমতো ব্যয় করা জরুরি। স্থানীয় সংস্থাগুলির খরচের উপর নজরদারি না রাখলে উন্নয়নমূলক তহবিলের অপচয় বাড়ে।”
একজন দপ্তরীয় কর্তা বলেন,
“বিনিয়োগ বা কাজের পরিকল্পনা আগে থেকে অনুমোদিত হতে হবে। রাজ্য সরকার কোনো অনিয়ন্ত্রিত ব্যয়ের দায় নেবে না।”
বিশ্লেষণ: আর্থিক জবাবদিহিতার পথে এক নতুন অধ্যায়
রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তকে অনেকে স্বাগতও জানিয়েছেন। প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে পুরসভার আর্থিক স্বচ্ছতা বাড়বে এবং ‘নগর উন্নয়ন তহবিল’ যথাযথভাবে ব্যবহৃত হবে। তবে একই সঙ্গে তাঁরা বলছেন,
“জরুরি পরিষেবার কাজে যদি অনুমোদন পেতে বিলম্ব হয়, তাহলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সাধারণ মানুষের ভোগান্তি ডেকে আনবে।”
সব মিলিয়ে, নবান্নের এই নতুন নীতিতে পুরসভাগুলির খরচে যেমন শৃঙ্খলা ফিরতে পারে, তেমনি প্রশাসনিক জটিলতা বাড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে রাজ্য সরকারের অবস্থান একটাই—“বেহিসেবি খরচ বন্ধ না হলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা টিকবে না।”
