কালীপুজোর রাতে বঙ্গের আকাশে ঘটতে চলেছে এক বিরল জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা। একসঙ্গে দেখা মিলবে দুই উজ্জ্বল ধূমকেতুর — ‘লেমন’ (C/2025 A6) ও ‘সোয়ান’ (C/2025 R2)। যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে এবং আকাশ মেঘমুক্ত হয়, তবে খালি চোখেই দেখা যাবে অন্তত একটি ধূমকেতু।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, ‘লেমন’ নামের ধূমকেতুটি পৃথিবীর আকাশে শেষবার দেখা গিয়েছিল প্রায় ১৩৫০ বছর আগে, অর্থাৎ অষ্টম শতাব্দীর শুরুর দিকে। অন্যদিকে ‘সোয়ান’ ধূমকেতুটি পৃথিবীর কাছাকাছি এসেছে প্রায় ৬৫০ বছর পর। এত দীর্ঘ বিরতির পর এই দুই মহাজাগতিক অতিথির একসঙ্গে আবির্ভাব— এক বিরল ও ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
যুগে যুগে ধূমকেতুর সাক্ষী ভারতীয় উপমহাদেশ
ঐতিহাসিকদের হিসেবে, ‘লেমন’ ধূমকেতু শেষবার পৃথিবীর কাছ দিয়ে গিয়েছিল রাজা শশাঙ্কের আমলে, যখন বাংলার রাজধানী ছিল গৌড় এবং উত্তর ভারতের প্রধান নগর কনৌজ। তখনও দিল্লি নামটি রাজনৈতিকভাবে তেমন গুরুত্ব পায়নি।
সেই সময়ে হর্ষবর্ধন ও শশাঙ্কের সংঘাত যখন ইতিহাসের পাতা রক্তিম করছিল, তখন হয়তো রাতের আকাশে হালকা নীলাভ–সবুজ আলোয় ঝলমল করছিল এই ‘লেমন’। তবে সেই যুগের মানুষ আদৌ তা লক্ষ্য করেছিল কি না, তা আজও অজানা।
অন্যদিকে, ‘সোয়ান’ ধূমকেতু পৃথিবীর কাছে এসেছিল তুঘলক আমলে, প্রায় ১৪শ শতকে। দিল্লির সুলতানি যুগ তখন মধ্যগগনে। ইতিহাসবিদদের ধারণা, সেই সময়কার জ্যোতিষীরা হয়তো এই উজ্জ্বল ধূমকেতুর আগমনকে শুভ–অশুভ সংকেত হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
বিজ্ঞানীদের চোখে ধূমকেতুর রহস্য
ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্সের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. সন্দীপ চক্রবর্তী ‘এই সময়’-কে বলেন,
“আকাশে একসঙ্গে দু’টি ধূমকেতুর দেখা পাওয়ার সুযোগ খুবই বিরল। বিশেষ করে সাধারণ মানুষ খালি চোখে একটি ধূমকেতু দেখতে পারবে, এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের খবর।”
তবে তিনি জানান, ‘সোয়ান’ ধূমকেতুটি ইতিমধ্যেই পৃথিবীর নিকটতম বিন্দু অতিক্রম করে ফেলেছে। ফলে সেটিকে দেখতে হলে টেলিস্কোপ বা দূরবিন প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে ‘লেমন’ তুলনামূলক উজ্জ্বল, তাই সেটি আকাশ পরিষ্কার থাকলে সহজেই দৃশ্যমান হবে।
কোথা থেকে এসেছে এই ধূমকেতুরা?
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানান, উভয় ধূমকেতুই এসেছে সৌরজগতের এক রহস্যময় অঞ্চল ‘ওর্ট ক্লাউড’ থেকে — যা নেপচুন গ্রহের অনেক ওপারে, পৃথিবী থেকে প্রায় দুই হাজার অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট (AU) দূরে অবস্থিত।
এক ‘AU’ মানে সূর্য ও পৃথিবীর গড় দূরত্ব, প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার। অর্থাৎ এই ধূমকেতুগুলি পৃথিবীতে পৌঁছাতে যে দূরত্ব অতিক্রম করেছে, তা কল্পনাতীত।
ওর্ট ক্লাউড মূলত এক বরফ ও ধুলিকণায় গঠিত অঞ্চল, যেখান থেকে দীর্ঘ সময় পরপর ধূমকেতুরা সূর্যের মহাকর্ষে আকৃষ্ট হয়ে অভ্যন্তরীণ সৌরজগতে প্রবেশ করে। সূর্যের তাপে গলে তাদের বরফ থেকে গ্যাস ও ধূলিকণা নির্গত হয়, যা উজ্জ্বল ‘লেজ’ তৈরি করে— আমরা যাকে ধূমকেতুর সৌন্দর্য বলে চিনি।
কালীপুজোর রাতেই দেখা মিলবে
জ্যোতির্বিদদের মতে, কালীপুজোর রাতে (২৫ অক্টোবরের পর) পশ্চিম দিগন্তে সূর্যাস্তের প্রায় এক ঘণ্টা পর আকাশে ধূমকেতুগুলির দেখা মিলতে পারে। ‘লেমন’ ধূমকেতুটি সবুজাভ আভা নিয়ে উত্তর–পশ্চিম দিগন্তে দৃশ্যমান হবে, যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর উজ্জ্বলতা বাড়বে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, “যাদের কাছে ছোট টেলিস্কোপ আছে, তারা ‘সোয়ান’কেও দেখতে পারবেন। তবে শহরের আলো দূষণ থেকে দূরে, গ্রাম বা পাহাড়ি অঞ্চলে পর্যবেক্ষণ সবচেয়ে উপযুক্ত হবে।”
বিরল এক মহাজাগতিক উৎসব
বাংলার মানুষ যেমন কালীপুজোর রাতে দেবী মায়ের আরাধনায় ব্যস্ত থাকবেন, তেমনই আকাশে ঘটবে এক অনন্য দৃশ্য— দেবীপ্রসাদে সাজানো রাতের আকাশে ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হতে থাকবে দুই ধূমকেতু।
দীর্ঘ ১৩ শতাব্দী পর একসঙ্গে এই দুই অতিথির আগমন নিঃসন্দেহে বাংলার রাতের আকাশে যুক্ত করবে এক নতুন রূপকথা।
ড. চক্রবর্তীর কথায়,
“ধূমকেতু আসলে সময়ের দূত— তারা মনে করিয়ে দেয়, মহাবিশ্বের সময় আমাদের চেয়ে অনেক বিশাল। আমরা ক্ষণিকের দর্শক মাত্র।”

সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited