দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরকে ঘিরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বহিরাগত’ মন্তব্যকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বিতর্কে নতুন মোড় এসেছে। শুক্রবার একাধিক কালীপুজোর উদ্বোধনী মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন— তাঁর বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। তিনি কোনো রাজ্যের নাগরিক বা সম্প্রদায়কে নয়, বরং একটি রাজনৈতিক দল ও তাদের আনা বহিরাগত কর্মীদের উদ্দেশেই সেই মন্তব্য করেছিলেন।
মমতার কথায়, “আমি বহিরাগত বলতে এখানে যারা থাকেন তাদের কথা বলিনি। আমি বলেছিলাম, একটা রাজনৈতিক দল বাইরের লোক এনে ভোটারদের নামের পাশে নাম তুলে দেয়, যাতে আমাদের এখানকার ভোটার ভোট দিতে না পারেন— আমি সেই ‘বহিরাগতদের’ কথাই বলেছি।”
তিনি এদিন গিরিশ পার্ক, জানবাজার ও শেক্সপিয়র সরণিতে একাধিক কালীপুজোর উদ্বোধনে অংশ নেন। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমার কথাকে প্রেস অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছে। আমি কাউন্সিলারদের বকছিলাম— কেন বস্তি উঠিয়ে বাংলার বাড়ি তৈরি করছ না? গরিবদের বস্তিতে থাকা অপরাধ নয়। কেউ জায়গা কিনে দুইশো মানুষকে তাড়িয়ে দেয়— তারাই আসল বহিরাগত।”
‘রাজনৈতিক বহিরাগত’ নিয়েই বক্তব্য
মমতা জানান, ভিন রাজ্যের মানুষ যারা দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করছেন, তারা তাঁর কাছে ‘বহিরাগত’ নন। বরং তিনি বলেন, “যাঁরা এখানে থাকেন, তাঁরা অনেক সময় বাঙালির থেকেও বেশি বাঙালি। তাঁদের ডান্ডিয়া, নবরাত্রি, হোলি— সব উৎসবে আমি হাত মেলাই, পা মেলাই। আমি সব উৎসবেই যোগ দিই। আমি যদি গুজরাটিদের সঙ্গে নাচি, রাজস্থানিদের অনুষ্ঠানে যাই, ইদের ইফতারে বা বড়দিনে অংশ নিই— তাতে কার কী আসে যায়?”
এই মন্তব্যে স্পষ্ট যে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের সাংস্কৃতিক বহুত্বের দিকটি তুলে ধরতে চেয়েছেন, যাতে ধর্ম বা জাতিগত বিভাজনের কোনো স্থান নেই।
বিরোধীদের কটাক্ষে পাল্টা জবাব
দুর্গাপুজোর সময় এক প্যান্ডেলে ডান্ডিয়া নাচে অংশ নেওয়া এবং রেড রোডের কার্নিভালে নাচের তালে তাল মেলানো নিয়ে বিরোধীরা তাঁকে কটাক্ষ করেছিল। এদিন মমতা পাল্টা বলেন, “বেশ করেছি। আমি যদি গুজরাটিতে সাথ দিই, রাজস্থানি বা বিহারিদের সঙ্গে থাকি— তাতে কার কী? আমি সব ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষকে সম্মান করি।”
তৃণমূলনেত্রীর বক্তব্যে বোঝা যায়, তাঁর ‘বহিরাগত’ প্রসঙ্গটি সাংস্কৃতিক নয়, বরং প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছিল— বিশেষ করে ভোটের সময় বাইরের লোক এনে প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি ইঙ্গিত করেই।
ভোট-রাজনীতি ও ভবানীপুরের প্রেক্ষাপট
ভবানীপুরে ২০২১ সালের উপনির্বাচনে মমতা ৭১ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন। তবে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সেই আসনে বিজেপি তুলনামূলক বেশি ভোট পায়, এবং তৃণমূলের লিড ছিল মাত্র আট হাজারের কিছু বেশি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রেক্ষিতেই মমতার বক্তব্যটি এসেছে— যাতে স্থানীয় সংগঠনকে আরও সক্রিয় হওয়ার নির্দেশনা ছিল, ‘বহিরাগত’ ইস্যু নয়।
মমতা বলেন, “ভবানীপুরের প্রতিটি ওয়ার্ড আমি চিনি। কোন বাড়িতে কে থাকে তাও জানি। আমি দীর্ঘদিনের বাসিন্দাদের উদ্দেশে কিছু বলিনি। কে কাকে ভোট দেবেন, সেটা তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার।”
নগর উন্নয়ন প্রসঙ্গে বক্তব্য
শেক্সপিয়র সরণির কালীপুজো উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “এবার কলকাতায় কিছু বহুতলে জল জমেছিল, কারণ ডেভেলপাররা ড্রেনের ব্যবস্থা না করে ভবন তৈরি করে দিয়েছে। আমি অ্যালার্ট করেছি। বড় বহুতল থেকে জল বের না হলে, আমি সরাব কোথা থেকে?”
তিনি পরিষ্কার জানান, নাগরিক সমস্যাগুলোর সমাধানে প্রশাসন কাজ করছে, তবে কাউন্সিলরদেরও দায়িত্ব নিতে হবে।
বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া
তবে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মমতার ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। তিনি বলেন, “কলকাতায় বৃষ্টি ও মুখ্যমন্ত্রীর উদাসীনতায় ১২ জন মারা গেছেন। পাহাড়ে ৩৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে জল ঢুকেছে, আর তিনি ফরাক্কাকে দোষ দিচ্ছেন!”
শুভেন্দুর বক্তব্যের জবাবে তৃণমূল সূত্রে জানানো হয়েছে, সরকার রাজ্যের প্রতিটি দুর্গত এলাকায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, এবং বিরোধীদের এই সমালোচনা ‘রাজনৈতিক কৌশল’ মাত্র।
শেষকথা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা মূলত একটি বার্তাই দিয়েছে— তিনি বিভাজনের নয়, ঐক্যের রাজনীতি করেন। তবে তাঁর মন্তব্যকে ঘিরে যে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা যে এত সহজে থামবে না, তা বলাই বাহুল্য।
