শহরের আকাশ এখন প্রায়ই ধূসর কুয়াশায় ঢেকে যায়। সকাল গড়ানোর আগেই সূর্যের আলো যেন মলিন হয়ে পড়ে দূষণের চাদরে। সন্ধ্যা নামলে আরও ঘন হয় সেই ছায়া। প্রকৃতির নয়, মানুষের সৃষ্ট এই কুয়াশা—দূষণের প্রতিচ্ছবি। কলকাতা মহানগরের বাতাস এখন দেশের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবার বড়সড় উদ্যোগ নিয়েছে কলকাতা পুরসভা ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ।
কারণ চিহ্নিত করে সমন্বিত উদ্যোগ
কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (পরিবেশ) স্বপন সমাদ্দারের ভাষায়,
“ব্যক্তিগত গাড়ির অতিরিক্ত ব্যবহার, যানজট, পুরনো যানবাহনের চলাচল এবং আবর্জনা পোড়ানোই শহরের বায়ু দূষণের মূল কারণ। এই সমস্যার মোকাবিলায় সরকারি সংস্থার পাশাপাশি নাগরিকদেরও অংশগ্রহণ জরুরি।”
পুরসভা জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে শহরের বায়ু পরিশুদ্ধ রাখতে বিভিন্ন দফায় প্রায় ১.১০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। এর মধ্যে অন্যতম উদ্যোগ হলো ৩০টি নতুন দূষণ পরিমাপক যন্ত্র কেনা। কলকাতা পুরসভা ও ট্র্যাফিক পুলিশ মিলে এই যন্ত্রগুলো স্থাপন করেছে গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ও ব্যস্ত সড়কে, যাতে দূষণের মাত্রা প্রতিনিয়ত মনিটর করা যায়।
আধুনিক যন্ত্রে দূষণ মনিটরিং
কর্তৃপক্ষের দাবি, নতুন যন্ত্র যুক্ত হওয়ায় শহরের যানবাহন-নির্ভর দূষণ পরিমাপের ক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অ্যান্টি-পলিউশন সেলেও যুক্ত হচ্ছে আধুনিক মনিটরিং সিস্টেম ও ডেটা অ্যানালাইসিস প্রযুক্তি।
এর পাশাপাশি শহরের রাস্তায় চলা পুরনো ও ধোঁয়া নির্গতকারী যানবাহন শনাক্ত করে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা নিচ্ছে ট্র্যাফিক পুলিশ। বেশ কয়েকটি মোড়ে ইতিমধ্যে পোর্টেবল দূষণ মাপার ডিভাইস বসানো হয়েছে, যা থেকে নির্গত ধোঁয়া অনুমোদিত মাত্রার বেশি হলে চালকের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে।
ধুলা নিয়ন্ত্রণে স্প্রিংকলার ও মিস্ট ক্যানন
শীতকালে ধুলোর পরিমাণ বেড়ে যায় বহুগুণ। এই সমস্যা কমাতে পুরসভা বড় মাপের স্প্রিংকলার ও মিস্ট ক্যানন সংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে নির্মাণাধীন স্থান ও প্রধান সড়কগুলোতে জল ছিটিয়ে ধুলা নিয়ন্ত্রণের কাজ হবে। একই সঙ্গে নির্মাণস্থলে ‘কভার সিস্টেম’ বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে যাতে বাতাসে ধুলাবালি ছড়াতে না পারে।
দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ জানিয়েছে, রাস্তার আবর্জনা ব্যবস্থাপনাও উন্নত করা হবে। এজন্য বাসিন্দাদের সক্রিয়ভাবে যুক্ত করতে নতুন হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর চালু হচ্ছে। নাগরিকেরা সেখানে আবর্জনা পোড়ানো, নির্মাণ বর্জ্য ফেলা বা খোলা জায়গায় ধুলো উড়ানো সংক্রান্ত ছবি ও তথ্য পাঠাতে পারবেন।
নাগরিক অভিযোগে সহজ ব্যবস্থা
রাজ্য পরিবেশ দপ্তরও সম্প্রতি চালু করেছে একটি টোল ফ্রি নম্বর (১৮০০৩৪৫৩৩৯০), যেখানে বায়ু বা পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত যেকোনো অভিযোগ জানানো যাবে। দপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নাগরিকদের অভিযোগের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একটি বিশেষ মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে।
পরিবেশকর্মীদের সতর্কবার্তা
তবে এতসব উদ্যোগের মধ্যেও প্রশ্ন উঠছে বাস্তবায়ন নিয়ে। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত মনে করেন,
“প্রচেষ্টা ভালো, কিন্তু এই উদ্যোগের মাত্রা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। সমস্যা চিহ্নিত করা গেলেও সমাধানে প্রশাসনের গতি ও গভীরতা নেই। শুধু পরিকল্পনা নয়, তার বাস্তবায়ন ও তদারকি নিশ্চিত করাই এখন জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, শহরের বাতাসের মান উন্নত করতে হলে গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, গণপরিবহন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও নির্মাণকাজের কঠোর বিধিনিষেধ প্রয়োজন।
দীর্ঘমেয়াদি নজরদারি জরুরি
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে নয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া শহরের বাতাসকে টেকসইভাবে পরিশুদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। স্কুল, হাসপাতাল ও বাজার এলাকার আশেপাশে নির্দিষ্ট বায়ু মান সূচক (AQI) বোর্ড বসানো হলে নাগরিকরাও সচেতন হতে পারবেন।
কলকাতা পুরসভার এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা চাই নাগরিকরাও এই উদ্যোগের অংশ হোক। দূষণ রোধ কেবল প্রশাসনের নয়, সবার দায়িত্ব।”
শহরের মানুষ আজ চায়—সকালবেলায় খোলা আকাশে হাঁটতে গিয়ে নিঃশ্বাসে টানুক তাজা বাতাস, না যে বিষাক্ত ধোঁয়া। সেই স্বচ্ছ আকাশ ফিরে পেতে প্রশাসন ও নাগরিক, উভয়েরই একযোগে সচেতন পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
