শারদীয় দুর্গোৎসবের আবহ শেষের পথে। সকাল থেকেই ঢাকের বোল বদলে গেছে, আনন্দঘন উৎসবে মিশে গেছে বিষাদের সুর। সিঁদুরখেলার রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে মণ্ডপ, দেবীর আরাধনায় শেষ আরতি সম্পন্ন হওয়ার পরই শুরু হয়েছে বিদায়ের পালা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে বছরের সবচেয়ে আবেগঘন দিন এটি—বিজয়া দশমী। মা দুর্গা কৈলাসে ফিরে যাচ্ছেন, আবারও শুরু হলো নতুন করে অপেক্ষা।
শহর থেকে গ্রামে বিদায়ের হাওয়া
কলকাতার বাগবাজার সর্বজনীন, শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে শুরু করে বেলুড় মঠ—সর্বত্র চলছে বিদায়ের প্রস্তুতি। সকাল থেকে পূজা মণ্ডপগুলোতে ভক্তদের ঢল নেমেছে। নারীরা সিঁদুর খেলে মায়ের পায়ের ছোঁয়া নিয়ে নিচ্ছেন আশীর্বাদ। একই চিত্র রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়।
বিজয়ার আচার সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি মণ্ডপে উচ্চারিত হচ্ছে একই প্রার্থনা—
“আবার এসো মা, আবার আলো ভরুক সংসারে।”
টাকিতে আন্তর্জাতিক বিসর্জন উৎসব
উত্তর ২৪ পরগনার টাকি সীমান্তে চলছে বিশেষ প্রথা। এখানকার পূবের বাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জনের পর একে একে শুরু হয় বারোয়ারি পূজোর বিসর্জন। বিশেষত্ব হলো—এখানে বিসর্জনের সময় ইছামতী নদীর ওপার থেকেও দেখা যায় প্রতিমা ভাসান। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার মানুষও চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করেন এই ঐতিহ্য। দুই দেশের সীমান্তজুড়ে তাই এদিন বাড়ানো হয় নিরাপত্তা।
কোচবিহারের বড়দেবীর বিসর্জন
অন্যদিকে কোচবিহারের রাজপরিবারের আরাধ্যা বড়দেবীর বিসর্জন ঘিরেও চলে উৎসবমুখর পরিবেশ। ভক্তরা সকাল থেকে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে বড়দেবীর সিঁদুর বরণে অংশ নেন। রক্তবর্ণা এই প্রতিমার সঙ্গে থাকেন দেবীর দুই সখী—জয়া ও বিজয়া। প্রথা অনুযায়ী স্থানীয় যমুনা দিঘিতে সম্পন্ন হয় প্রতিমা বিসর্জন। এর আগে হাজারো মানুষ দেবীকে প্রণাম জানাতে ভিড় করেন।
ঢাক-শহরতলি ও গ্রামবাংলায় একই আবহ
শুধু কলকাতা বা সীমান্ত নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতেও চলছে একই আবেগঘন দৃশ্য। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলায় সকাল থেকে প্রতিমার সামনে ভিড় জমেছে। ঢাকের তাল, উলুধ্বনি আর শঙ্খের ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছে চারপাশ। অনেক মণ্ডপে প্রতিমা বিসর্জন হলেও কিছু জায়গায় দ্বাদশী পর্যন্ত প্রতিমা রাখা হবে, যাতে ভক্তরা আরও কিছুটা সময় দেবীর দর্শন পেতে পারেন।
আনন্দের সঙ্গে বিষাদের মিলন
দশমীর বিশেষ আচার ‘উমাবরণ’ ও ‘সিঁদুরখেলা’ ঘিরে নারীদের মধ্যে ছিল বিশেষ উচ্ছ্বাস। শাড়ির আঁচলে সিঁদুর লেগে রইল শুভতার প্রতীক হয়ে। তবে এই আনন্দের ভেতরেই যেন লুকিয়ে ছিল বিষাদ—কারণ আজই দেবীর বিদায়।
উৎসব শেষে মণ্ডপে মণ্ডপে ভক্তদের চোখে জল, ঠোঁটে একটাই প্রার্থনা—
“মা, আমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করে আগামী বছর আবার এসো।”
এক বছরের অপেক্ষা শুরু
শারদীয় দুর্গোৎসব শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বাঙালির জীবনের সবচেয়ে বড় সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসব। পূজা শেষ মানেই বাঙালির হৃদয়ে অপেক্ষা—পরের বছরের শারদ আগমনের। দেবী বিদায় নিলেও রয়ে যায় তাঁর আশীর্বাদ, তাঁর উপস্থিতির অনুভব।
