কলকাতার আকাশে তখনো কালো মেঘের ঘনঘটা। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছিল, আজ রাত থেকে বৃষ্টি আরও জোরালো হবে। কিন্তু বৃষ্টি–ঝড়ের ভয় উপেক্ষা করে মহানবমীর সকাল থেকেই পুজোর আনন্দে মেতে উঠেছে শহরবাসী। টালা প্রত্যয় থেকে শুরু করে ম্যাডক্স স্কয়ার—শহরের নানা প্রান্তে ভিড় উপচে পড়েছে। রাত পোহালেই বিজয়ার বিষণ্নতা, ফের শুরু হবে অপেক্ষা আরেক বছরের। তাই শেষ দিনের আনন্দটা যেন মানুষ দু’হাত ভরে উপভোগ করতে চাইছেন।
টালা প্রত্যয়ের বিশেষ আয়োজন
প্রতিবারের মতো এবারও চমক দিয়েছে টালা প্রত্যয়। কৃষিকাজের নানা মুহূর্তের ছবি তুলে ধরে তৈরি হয়েছে এ বছরের থিম—‘বীজ অঙ্গন’। কৃষি ও প্রকৃতির চিরন্তন বন্ধন ফুটে উঠেছে প্রতিটি কারুকাজে। এর সঙ্গে বৃষ্টির এক অদ্ভুত মেলবন্ধন যেন প্রতিফলিত হচ্ছে মণ্ডপজুড়ে।
তবে ভিজে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই এখানে। পুরো মণ্ডপে বিশেষ আচ্ছাদন তৈরি করে দর্শনার্থীদের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ রাখা হয়েছে। ভেতরে ঢুকলে অন্তত ৪৫ মিনিট সময় নিয়ে আরামে প্রতিমা দর্শন ও থিম উপভোগ করা সম্ভব। তাই সকাল থেকেই টালা প্রত্যয়ের প্যান্ডেলে ঢল নেমেছে দর্শনার্থীদের।
ম্যাডক্স স্কয়ারে ভিড়ের ঢল
অন্যদিকে শহরের দক্ষিণে ম্যাডক্স স্কয়ারও মহানবমীর অন্যতম আকর্ষণ। এবার নাটমন্দিরের আদলে তৈরি হয়েছে মণ্ডপ। প্রতিমাও একেবারে সাবেকি, ঐতিহ্যবাহী রূপে সাজানো। এ কারণে দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন এখানে।
তবে এ বছর মণ্ডপ প্রাঙ্গনকে ঘিরে এক বড় সংকট পেরোতে হয়েছে আয়োজকদের। গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রবল বর্ষণে এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল। কার্যত মণ্ডপজুড়ে পানি জমে গিয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তারা। এখন নবমীর রাতে দুর্যোগের ভ্রুকুটি থাকলেও মানুষের উচ্ছ্বাসে কোনো ভাটা পড়েনি। মহাআরতির সময় দর্শনার্থীদের ঢল আরও বেড়েছে।
আবহাওয়ার প্রভাব ও সতর্কবার্তা
আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি আরও তীব্র হতে পারে। এর ফলে শহরের নানা প্যান্ডেলে দর্শনার্থীদের অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আয়োজকরা আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়েছেন। বেশিরভাগ বড় পুজো মণ্ডপে ছাউনির ব্যবস্থা থাকায় মানুষ নির্বিঘ্নে প্রতিমা দর্শন করতে পারছেন।
তারকা ও রাজনীতিকদের পুজো উপভোগ
শহরের নানা প্রান্তের মণ্ডপে পুজোর আনন্দ উপভোগ করেছেন সেলেব্রিটি ও রাজনৈতিক নেতারাও। শিবমন্দিরে ধুনুচি নাচে অংশ নেন টলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। অভিনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নবমীতেও একাধিক মণ্ডপে ঘুরে বেড়ান।
মহানবমীতে দক্ষিণ কলকাতার সুরুচি সংঘে দেখা মেলে একঝাঁক তারকার। মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে ঢাক বাজালেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও অভিনেতা আবীর চট্টোপাধ্যায়। দু’জনের ঢাক বাজানোতে দর্শনার্থীদের উচ্ছ্বাস তুঙ্গে ওঠে।
এছাড়া শ্রীভূমির মণ্ডপে সন্ধ্যায় ঢাক বাজাতে দেখা যায় মন্ত্রী সুজিত বসুকে। তার পাশে কাঁসর বাজিয়ে মাতৃবন্দনায় যোগ দেন তাঁর কন্যা।
মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতি
মহানবমীর সন্ধ্যায় কালীঘাট মন্দিরে আরতি করতে দেখা গেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। নিজ হাতে কাঁসর বাজিয়ে মায়ের পায়ে অঞ্জলি দেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী ও অনুগামীরা। দর্শনার্থীদের ভিড় তখন চোখে পড়ার মতো।
শেষ দিনের আবেগ
মহানবমী মানেই উৎসবের শেষ প্রহর। রাত পোহালেই বিজয়ার বিষণ্নতা। তাই বৃষ্টি উপেক্ষা করে শেষবারের মতো মণ্ডপ দর্শনে ব্যস্ত মানুষ। পরিবার, বন্ধু আর প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সবাই। অনেকেই বলছেন, “বছরে একবারই তো আসে এই আনন্দ। তাই বৃষ্টির জন্য তো আর থেমে থাকা যায় না।”
কলকাতার প্রতিটি পুজো মণ্ডপ যেন আজ এক একটি মিলনক্ষেত্র। বৃষ্টি–ঝড়, আবহাওয়ার সতর্কবার্তা, যানজট—সবকিছুকেই পেছনে ফেলে পুজোই হয়ে উঠেছে শহরের প্রাণস্পন্দন।
