হিমালয়ের কোলে শীতল মরু লাদাখ। তুষারাবৃত, নির্জন—প্রকৃতির আঁচলে ঘেরা এই অঞ্চল কয়েক দশক ধরেই বৌদ্ধপ্রধান লেহ ও মুসলিমপ্রধান কার্গিলের শীতল দ্বন্দ্বের সাক্ষী। ২০১৯ সালেও কংগ্রেস নেতা আসগর আলি কারবালাই বলেছিলেন—বৌদ্ধদের সামাজিক বয়কট মুসলিমদের জন্য এখনও বাস্তব। জমি কেনাবেচাও সীমিত।
কিন্তু বিজেপির দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ সেই চিরচেনা দ্বন্দ্বকে ছাপিয়ে নিয়ে এসেছে নতুন বাস্তবতায়। লাদাখের বৃহত্তর স্বার্থে একজোট হয়েছেন দুই সম্প্রদায়।
প্রতিশ্রুতির ফাঁদ ও ‘ধোঁকা’র ক্ষত
২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার সময় বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল—লাদাখকে ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, স্থানীয় ভাষা ‘ভোটি’ সংবিধানের অষ্টম তফসিলে স্থান পাবে। লেহ-র উৎসবমুখর সমর্থন আর কার্গিলের ক্ষোভের ভেতর দিয়েই জন্ম নেয় কেন্দ্রশাসিত লাদাখ।
কিন্তু দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে যায়—ষষ্ঠ তফসিলের প্রতিশ্রুতি কার্যত ফিকে। বারবার বিকল্প প্রস্তাব, অনিশ্চিত আশ্বাস আর সময়ক্ষেপণের ফলে ভরসা হারায় স্থানীয়েরা। ক্ষোভ ক্রমশ বিস্তার লাভ করে।
প্রতিবাদ থেকে সংঘাতে: সোনম ওয়াংচুক ও আন্দোলনের বিস্তার
শিক্ষাবিদ ও পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুকের শান্তিপূর্ণ অনশন হয়ে ওঠে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। পাঁচ সপ্তাহব্যাপী অনশনের ১৪তম দিনে বৃদ্ধদের অসুস্থ হয়ে পড়া, এরপর আকস্মিক বিক্ষোভ—যা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হয়ে গড়ায় পুলিশের গুলিতে। নিহত চারজন, আহত ডজনাধিক।
সরকার এর দায় চাপিয়েছে সোনমের উপর। তাঁর বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ, বিদেশি অনুদান বন্ধ, পাকিস্তানি চরের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়েছে।
জমি, চাকরি ও সাংবিধানিক সুরক্ষার দাবিতে জনজাগরণ
লাদাখিদের দাবি চারটি—
১. রাজ্যের মর্যাদা ও বিধানসভা পুনরুদ্ধার
২. ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে সাংবিধানিক সুরক্ষা
৩. পাবলিক সার্ভিস কমিশন ও স্থানীয় কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা
৪. অতিরিক্ত সংসদীয় আসন
একই সঙ্গে জমি অধিগ্রহণের প্রশ্ন স্থানীয়দের ক্ষোভ আরও বাড়িয়েছে। চাংথাং অঞ্চলে ৫০,০০০ একর জমি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে তুলে দেওয়ার খবর ঘিরে যাযাবর চাংপা সম্প্রদায় ও স্থানীয়রা সরব। তাঁদের আশঙ্কা—প্রকল্প মানেই চারণভূমি হারানো, জীবনধারার বিপন্নতা।
চাংপা সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের লড়াই
৪,০০০ থেকে ৭,০০০ মিটার উচ্চতার চাংথাং মালভূমি চাংপাদের আবাস। ভেড়া-ছাগল পালনের মাধ্যমে টিকে থাকা এই জনগোষ্ঠী তৈরি করে বিশ্বখ্যাত পশমিনা। অথচ তাঁদের জমির কোনও আইনি মালিকানা নেই। সরকারের প্রকল্প মানে তাঁদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি।
মেষপালক লবজাং দাদুলের কথায়—
“আমরা উন্নয়নের বিরোধী নই। কিন্তু উন্নয়ন হতে হবে ন্যায্য, অংশগ্রহণমূলক। চারণভূমি, চাকরি ও রাজস্বে আমাদের ভাগ নিশ্চিত করতে হবে।”
লাদাখ এখন আগুনের ফুলকি
আজ লাদাখের দুই প্রধান শক্তি—লেহ অ্যাপেক্স বডি (এলএবি) ও কার্গিল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (কেডিএ)—একসঙ্গে লড়ছে। আন্দোলনের আন্তর্জাতিক মুখ সোনম হলেও, মাটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন থুপস্তান ছেওয়াং, চেরিং দোর্জে, আসগর আলি কারবালাই, সাজ্জাদ কার্গিলি প্রমুখ।
চেরিং দোর্জের সতর্কবাণী—
“অতিরিক্ত দমন ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। ষষ্ঠ তফসিল ছাড়া নিস্তার নেই।”
এক নতুন মণিপুর, এক নতুন কাশ্মীর?
কার্ফু, ধরপাকড়, ইন্টারনেট বন্ধ, গণসমাবেশে নিষেধাজ্ঞা, সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ আটকে দেওয়া—সব মিলিয়ে আজ লাদাখ যেন কাশ্মীর কিংবা মণিপুরের প্রতিচ্ছবি।
যেখানে একসময় অভ্যন্তরীণ বিভাজনই ছিল বড় সংকট, আজ সেখানে বৃহত্তর স্বার্থে মুসলিম ও বৌদ্ধেরা ঐক্যবদ্ধ। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, জমি দখল ও সাংবিধানিক সুরক্ষার প্রশ্নে তাদের সংগ্রাম এখন শুধু আঞ্চলিক নয়—জাতীয় আলোচনার বিষয়।
