সপ্তমীর দিন কলকাতা ও আশপাশের জেলাজুড়ে ছিল ঝলমলে রোদ। বিকেল গড়িয়ে রাত পর্যন্ত ঠাকুর দেখার ভিড় জমে গিয়েছিল শহরের প্যান্ডেলে। আবহাওয়ার কোনো বাধা না থাকায় মানুষ মেতে উঠেছিল উৎসব আনন্দে।
কিন্তু আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাসে শঙ্কা—এই সুখ দীর্ঘস্থায়ী নয়। অষ্টমীতেই উত্তর আন্দামান সাগরে তৈরি হতে চলেছে ঘূর্ণাবর্ত, যা নবমীর মধ্যে নিম্নচাপ অঞ্চলে পরিণত হবে।
নিম্নচাপের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
আবহাওয়াবিদদের মতে, বঙ্গোপসাগরের উপর মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় এই ঘূর্ণাবর্ত দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করছে। সাধারণত অক্টোবর মাসে বঙ্গোপসাগরে সিস্টেম তৈরি হলে তা দক্ষিণবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবল বৃষ্টি নামায়।
- অষ্টমী: ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হবে।
- নবমী: নিম্নচাপে রূপ নেবে।
- দশমী ও একাদশী: বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ঝড়বৃষ্টি এবং অতি ভারী বৃষ্টি দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে।
এমন পরিস্থিতিতে আবহাওয়াবিদরা সতর্ক করেছেন—টানা বৃষ্টিতে নদীবিধৌত এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হতে পারে, গ্রামীণ রাস্তাঘাট ও ফসলের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
কোন জেলায় কেমন সতর্কতা?
আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস অনুযায়ী—
- সপ্তমীর রাত:
- হুগলি, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পূর্ব বর্ধমান ও ঝাড়গ্রামে দু’এক পশলা বৃষ্টি।
- ঘণ্টায় ৩০–৪০ কিমি বেগে ঝোড়ো হাওয়া বইতে পারে।
- অষ্টমী:
- হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, দুই বর্ধমান, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি।
- নবমী:
- দুর্যোগ বাড়বে। বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড়বৃষ্টি একাধিক জেলায়।
- দশমী ও একাদশী:
- কলকাতা, হাওড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পূর্ব বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়ায় ভারী বৃষ্টি।
- উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি ও পূর্ব মেদিনীপুরে অতি ভারী বৃষ্টি (৭–২০ সেমি)।
- এই চার জেলায় কমলা সতর্কতা জারি।
মানুষের অনুভূতি ও উৎসবের পরিকল্পনা
পুজো মানেই সারাবছরের অপেক্ষার পর আনন্দে মেতে ওঠা। সপ্তমীতে আবহাওয়া ভালো থাকায় হাজারো মানুষ বেরিয়েছিলেন ঠাকুর দেখতে। কিন্তু নবমী ও দশমীর পূর্বাভাস ঘিরে চিন্তিত এখন অনেকে।
- অনেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অষ্টমীতেই বেশি করে ঠাকুর দেখা সেরে ফেলবেন।
- নবমীতে দুর্যোগ এড়াতে অনেক পরিবার আগেভাগেই ভ্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করছেন।
- পরিবহন খাতে আশঙ্কা—ঝড়বৃষ্টির কারণে রাস্তায় যানজট, ট্রেন-বাস চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
একজন কলকাতাবাসীর মন্তব্য—
“সপ্তমীর রাতে খুব ভালোভাবে ঠাকুর দেখলাম। কিন্তু যদি দশমীতে বৃষ্টি হয়, তাহলে হয়তো আর বেরোনো সম্ভব হবে না। তাই অষ্টমীতেই বড় মণ্ডপগুলোতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি।”
ব্যবসা ও মেলার উপর প্রভাব
দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি কোটি টাকার অর্থনীতির সঙ্গেও জড়িত। প্যান্ডেল, ফুড স্টল, মেলা, পোশাক ও অলংকার বিক্রির মূল ভরসা থাকে এই কয়েকদিনের উপর।
- বৃষ্টির কারণে ক্রেতাদের সংখ্যা কমে গেলে ব্যবসায়ীরা বড় ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন।
- ফুড স্টলে ভিড় কমলে ক্ষতির আশঙ্কা।
- প্যান্ডেলে ভিজে যাওয়া আলোকসজ্জা ও সাজসজ্জারও ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
প্রশাসনের প্রস্তুতি
আবহাওয়া দফতরের সতর্কতা মাথায় রেখে কলকাতা পুলিশ ও প্রশাসন আগেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
- বৃষ্টির দিনে ভিড় নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা।
- ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন।
- জরুরি পরিষেবা সচল রাখতে বিদ্যুৎ ও টেলিকম বিভাগকে সতর্ক নির্দেশ।
সপ্তমীর ঝলমলে আকাশের আনন্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির অঘোষিত হুঁশিয়ারি। নবমী থেকে দশমী পর্যন্ত দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে সম্ভাব্য দুর্যোগে পুজোর আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে শঙ্কা।
তবুও বাঙালি উৎসবপ্রেমীদের আশা—প্রকৃতি যদি সঙ্গ দেয়, তবে এই বছরের পুজোও হয়ে উঠবে আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর ভক্তির মিলনমেলা।
