পাহাড়ি প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন খাগড়াছড়ির কৃষকরা। তারা এখন নদী ও ছড়ার স্রোত ব্যবহার করে পাহাড়ি জাম্বুরা পরিবহণ করছেন, ফলে ব্যয় যেমন অনেকটা কমে যাচ্ছে, তেমনি ফলের ক্ষতিও হচ্ছে না।
প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে—পাহাড়ি নদীতে অসংখ্য জাম্বুরা ভেসে বেড়াচ্ছে, যেন পচে গাছ থেকে পানিতে পড়ে গেছে। কিন্তু আসলে এটি পাহাড়ি কৃষকদের অভিনব কৌশল। পাহাড়ি গ্রাম থেকে দূরের বাজারে ফল পরিবহণের জন্য তারা প্রকৃতির স্রোতকেই বেছে নিয়েছেন।
প্রকৃতির পাঠই দিয়েছে সহজ বিজ্ঞান
সৃষ্টির আদি থেকেই মানুষ প্রকৃতির উপকরণ ব্যবহার করে টিকে থাকার পথ খুঁজে নিয়েছে। পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ সেই প্রাকৃতিক জ্ঞানই কাজে লাগাচ্ছেন আধুনিক প্রয়োজনে। এখন পাহাড়ে জাম্বুরার মৌসুম। উঁচু গাছের ডালে ডালে ঝুলে থাকা বিশাল আকারের জাম্বুরা দেখতে যেমন সুন্দর, বাজারে এর চাহিদাও তেমনি বেশি। কিন্তু দুর্গম পাহাড়ি সড়ক ও যানবাহনের অভাবে বাজারে পৌঁছানোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এই সমস্যার সমাধান হিসেবে কৃষকরা বেছে নিয়েছেন ‘ভাসমান পরিবহণ পদ্ধতি’। পাহাড়ের বাগান থেকে জাম্বুরা সংগ্রহ করে নদী বা ছড়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট জায়গায় বাঁশের জালে এগুলো আটকে রাখা হয়। পরে সেখানেই বাছাই, ধোয়া ও প্যাকেটজাতের কাজ সম্পন্ন হয়।
‘পানির স্রোতই আমাদের ট্রাক’
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার কৃষক অসিত বরন চাকমা বলেন,
“আমাদের গ্রাম থেকে বাজার পর্যন্ত পাহাড়ি মাটির রাস্তা, যেখানে ট্রাক বা ভ্যান যায় না। আগে ভাড়া করা শ্রমিক দিয়ে ফল নামাতে খরচ হতো অনেক। এখন নদীর স্রোতেই জাম্বুরা ভাসিয়ে আনি। এতে খরচ এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে।”
তিনি আরও বলেন, “পানিতে ভাসালে কোন জাম্বুরা ভালো আর কোনটা পচা, তা সহজেই বোঝা যায়। ভালো জাম্বুরা ভাসে, পচা ডুবে যায়। তাই বাছাই কাজও সহজ।”
স্থানীয় আরেক কৃষক কালায়ন চাকমা জানান, প্রাকৃতিক এই পরিবহণ পদ্ধতির ফলে তাদের লাভ অনেক বেড়েছে। “আগে প্রতি মণ জাম্বুরা বাজারে পৌঁছাতে ২০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতো। এখন তা ৫০ টাকার কমে নামানো যায়। এতে বাজারমূল্য বাড়লেও আমরা ক্রেতাদের কম দামে দিতে পারছি।”
বাজারে চাহিদা বাড়ছে ‘ভাসমান জাম্বুরা’র
স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. রইস উদ্দিন বলেন, “ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী—সব বড় শহরেই এখন পাহাড়ি জাম্বুরার দারুণ চাহিদা। আকারে বড়, রসালো এবং স্বাদে মিষ্টি হওয়ায় ক্রেতারা খুশি। তাছাড়া এসব জাম্বুরা সম্পূর্ণ জৈব উপায়ে চাষ করা হয়, কোনো রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। তাই স্বাস্থ্যসম্মত ফল হিসেবে এদের কদর দ্রুত বাড়ছে।”
বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে এখন পাহাড়ি জাম্বুরার ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি হচ্ছে। অনেক পাইকার খাগড়াছড়ি, মহালছড়ি ও দীঘিনালা থেকে সরাসরি অর্ডার নিচ্ছেন।
কৃষি কর্মকর্তার ভাষায়—‘এ এক সৃজনশীল বিপ্লব’
মহালছড়ি উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ রসুল বলেন,
“পাহাড়ি অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া জাম্বুরা চাষের জন্য দারুণ উপযোগী। কৃষকরা এখন শুধু ফল উৎপাদনেই নয়, পরিবহণেও অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করছেন—এটি এক ধরনের কৃষি উদ্ভাবন।”
তিনি জানান, পানি ব্যবহার করে ফল পরিবহণ করায় খরচ কমছে, ফলের ক্ষতি কমছে, আর পরিবেশও রক্ষা পাচ্ছে। “এটি একেবারে প্রকৃতি-বান্ধব প্রক্রিয়া। আমরা চাই এই পদ্ধতি অন্য ফল পরিবহণেও ব্যবহার হোক।”
প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানই টেকসই উন্নয়ন
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পাহাড়ি কৃষকদের এই বুদ্ধিদীপ্ত পদ্ধতি শুধু অর্থনৈতিক সাশ্রয় নয়, বরং টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব কৃষির মডেল হয়ে উঠতে পারে।
নদীর স্রোত ব্যবহার করে ফল পরিবহণে কোনো জ্বালানি লাগে না, তাই কার্বন নিঃসরণও নেই। একই সঙ্গে শ্রম ও সময় দুটোই বাঁচে। ফল ভাসানোর দৃশ্য এখন স্থানীয় পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে—যা পাহাড়ের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করছে।
খাগড়াছড়ির পাহাড়ি কৃষকদের এই ‘ভাসমান জাম্বুরা’ উদ্যোগ শুধু ফল পরিবহণের গল্প নয়; এটি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্বের প্রতীক। কঠিন ভূপ্রকৃতি, সীমিত সম্পদ ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তারা দেখিয়ে দিচ্ছেন—প্রকৃতিই হতে পারে সবচেয়ে বড় সহযোগী।
প্রকৃতির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে, পরিশ্রম ও প্রজ্ঞায় তারা লিখছেন এক নতুন সাফল্যের গল্প—যেখানে নদীর স্রোতই হয়ে উঠেছে পাহাড়ি কৃষকের পরিবহণ মাধ্যম, আর জাম্বুরা ভেসে বেড়াচ্ছে উন্নয়নের পথে।
