খুলনার উপকূলীয় এলাকায় কৃষকদের মধ্যে নতুন করে আগ্রহ জাগাচ্ছে সবুজ সার (Green Manure)। রাসায়নিক সারের টেকসই বিকল্প হিসেবে এই ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, বরং উৎপাদন খরচও কমাচ্ছে এবং মাটির উর্বরতা পুনরুদ্ধারে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দিকনির্দেশনায় খুলনার বিভিন্ন উপজেলায় কৃষকরা এখন রাসায়নিক সার ছাড়াই সফলভাবে ধান চাষে সবুজ সার ব্যবহার করছেন। ধৈইঞ্চা গাছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে টেকসই কৃষির এক নতুন দিগন্ত।
ধৈইঞ্চা চাষে রাসায়নিকবিহীন ধান উৎপাদন
খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার শুড়িখালী গ্রামের কৃষক মো. শাহজাহান হোসেন এ বছর তাঁর ৭০ শতাংশ জমিতে কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার না করেই রোপা আমন ধান চাষ করেছেন। তিনি রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জমিতে সবুজ সার হিসেবে ধৈইঞ্চা গাছ ব্যবহার করেছেন।
শাহজাহান বলেন,
“বোরো ধান কাটার পর আমি ধৈইঞ্চার বীজ বপন করি। প্রায় ৪৫ দিনের মধ্যে গাছগুলো বড় হলে সেগুলোসহ জমি চাষ করি। কোনো রাসায়নিক ব্যবহার ছাড়াই আমার ধান ভালোভাবে বেড়ে উঠেছে, ফলে প্রায় ৬–৭ হাজার টাকা সাশ্রয় হয়েছে।”
তাঁর দেখাদেখি পার্শ্ববর্তী গঙ্গারামপুর ও চক্রখালী গ্রামের কৃষকরাও এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন এবং ইতিমধ্যে আশাব্যঞ্জক ফলাফল পাচ্ছেন।
কৃষক আব্দুল হামিদ বলেন, “প্রথমবারের মতো আমি ইউরিয়া ছাড়াই ধান চাষ করেছি। ফলন ভালো হওয়ায় আগামী বছর আরও ১২ বিঘা জমিতে ধৈইঞ্চা বুনে চাষ করার পরিকল্পনা করেছি।”
সবুজ সারের উপকারিতা: মাটির জন্য আশীর্বাদ
কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, সবুজ সার মাটিতে জৈব পদার্থ বাড়ায় এবং নাইট্রোজেন যোগায়, যা ইউরিয়া সারের প্রাকৃতিক বিকল্প হিসেবে কাজ করে। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, এক হেক্টর জমিতে ধৈইঞ্চা গাছ ৬০ থেকে ৮০ কেজি পর্যন্ত নাইট্রোজেন সরবরাহ করতে পারে।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জীবনানন্দ রায় বলেন,
“উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা ও দীর্ঘদিনের রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। তাই আমরা কৃষকদের ধৈইঞ্চা চাষে উৎসাহিত করছি। ইতোমধ্যেই শুড়িখালীতে প্রায় ১১০ বিঘা জমিতে সবুজ সার ব্যবহারের আওতায় এসেছে।”
কৃষিবিদদের মতে, ধৈইঞ্চা গাছের শিকড়ে ‘রাইজোবিয়াম’ নামক ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে মাটিতে সংযোজন করে। এর ফলে মাটির জৈব গুণাগুণ উন্নত হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে জমি চাষযোগ্য থাকে।
সরকারি উদ্যোগে সম্প্রসারণ: খুলনা জোনে বাড়ছে সবুজ সার চাষ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খুলনা জোন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইল জেলায় প্রায় ৩ হাজার কৃষক ৪৭৪ হেক্টর জমিতে ধৈইঞ্চা বুনেছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক জানান,
“তরমুজ চাষের পর আমরা প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় ২১০ জন কৃষককে ৫ কেজি করে ধৈইঞ্চা বীজ বিতরণ করেছি। ৪৫ দিন পর গাছগুলো মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। এতে মাটির গঠন উন্নত হয়, উৎপাদন খরচ কমে এবং ধান ও অন্যান্য ফসলের ফলনও ভালো হয়।”
তিনি আরও বলেন, এ পদ্ধতি একদিকে কৃষকের খরচ কমাচ্ছে, অন্যদিকে সরকারকেও বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি থেকে মুক্তি দিতে পারে।
অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সুবিধা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৫০–৫৫ লাখ টন রাসায়নিক সার ব্যবহার হয়, যার মধ্যে ২৬–২৭ লাখ টন ইউরিয়া সার। এই ইউরিয়া সারের জন্য সরকারকে বছরে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়।
সবুজ সার ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা গেলে এই খরচের বড় একটি অংশ বাঁচানো সম্ভব, একই সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রে পরিবেশদূষণও কমবে।
কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুস সালাম বলেন,
“সবুজ সার ব্যবহারে মাটির গুণগত মান উন্নত হয়, জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায় এবং কার্বন নির্গমন হ্রাসে অবদান রাখে। এটি কৃষিকে শুধু টেকসই নয়, জলবায়ু-সহনশীলও করে তোলে।”
টেকসই কৃষির নতুন সম্ভাবনা
খুলনার কৃষকদের হাতে এখন সেই আশার আলো—যেখানে রাসায়নিকের বদলে প্রকৃতি নিজেই সার জোগায়, আর খরচ কমে আসে অর্ধেকে।
সবুজ সারের এই পুনর্জাগরণ প্রমাণ করছে, পুরোনো ঐতিহ্যকেই আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে মিলিয়ে বাংলাদেশের কৃষি খাতকে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পথে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।
