বান্দরবানের থানচি উপজেলার বিখ্যাত নাফাখুম জলপ্রপাত থেকে নিখোঁজ হওয়া পর্যটক মো. ইকবাল হাসাইন (২৪)-এর মরদেহ তিন দিনের প্রচেষ্টায় উদ্ধার করা হয়েছে। রোববার বিকেল চারটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের বিশেষ ডুবুরি দল জলপ্রপাতের নিচে অবস্থিত একটি গভীর গুহা বা ‘কুম’ থেকে তার লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় এলাকায় পর্যটন নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের অফিসার ও ডুবুরি দলের প্রধান রহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের দল টানা আট ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে মরদেহটি উদ্ধার করেন। ডুবুরি দল অক্সিজেন সেট পরে কয়েকবার গুহার ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা চালায় এবং শেষ পর্যন্ত গভীর পানির নিচে আটকে থাকা লাশটি শনাক্ত ও উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
ঘটনার সূত্রপাত শুক্রবার সন্ধ্যায়
স্থানীয় সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার ঢাকার ডেমরা এলাকা থেকে ১৭ জনের একটি পর্যটক দল থানচিতে পৌঁছায় এবং সেদিনই নাফাখুম জলপ্রপাত পরিদর্শনে যায়। সন্ধ্যার দিকে খুমে গোসল করতে নেমে দুর্ঘটনার শিকার হন ইকবাল। সেসময় পানি প্রবাহ ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি, এবং পিচ্ছিল পাথরের কারণে তিনি ভারসাম্য হারিয়ে পানির নিচের গুহায় ডুবে যান বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঘটনার পর পর্যটকের সঙ্গীরা সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার কাজ শুরু করতে পারেননি। নাফাখুম এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় থানচি থানা বা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। পরদিন শনিবার সকালে দলের পাঁচ সদস্য প্রায় কয়েক ঘণ্টার পথ হেঁটে থানচি সদর পৌঁছে থানায় লিখিতভাবে জানানোর পর উদ্ধার অভিযান শুরু হয়।
বহু সংস্থার অংশগ্রহণে উদ্ধার অভিযান
স্থানীয় প্রশাসন, বিজিবি, থানচি থানা পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের যৌথ উদ্যোগে জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা হয়। জলপ্রপাতের প্রকৃতি অত্যন্ত বিপজ্জনক হওয়ায় ডুবুরি দল শুরুতে তেমন অগ্রগতি করতে পারছিল না। নাফাখুমের পানির নিচে একাধিক গভীর গুহা রয়েছে, যেগুলোতে স্রোতের কারণে প্রবেশ করা কঠিন।
ডুবুরি দলের প্রধান রহিদুল ইসলাম বলেন,
“জলপ্রপাতের নিচে একটি গভীর কুম রয়েছে। মরদেহটি সেই গুহার ভেতরে আটকে ছিল। আমরা তিনজন ডুবুরি অক্সিজেন সেট পরে প্রায় আট ঘণ্টার চেষ্টা চালিয়ে ইকবালের দেহ উদ্ধার করি। প্রবল স্রোত ও অন্ধকার গুহা উদ্ধারকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছিল।”
মরদেহ হস্তান্তর সোমবার
থানচি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাছির উদ্দিন মজুমদার জানান, মরদেহ থানা-মর্গে আনা হচ্ছে। দুর্গম পথ হওয়ায় রাত হয়ে যেতে পারে। সোমবার সকালে নিহত পর্যটক ইকবাল হাসাইনের মরদেহ তার পরিবারকে হস্তান্তর করা হবে বলে তিনি জানান।
পর্যটন নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
নাফাখুমকে বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় জলপ্রপাত বলা হয়, যেখানে প্রতি বছর হাজারো পর্যটক ভিড় জমান। তবে পর্যটন বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন—
- এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই
- ট্রেইলে গাইড সিস্টেম সঠিকভাবে কার্যকর নয়
- ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত বা সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড নেই
- সবচেয়ে বড় সমস্যা নেটওয়ার্ক সংকট, ফলে জরুরি মুহূর্তে যোগাযোগ সম্ভব হয় না
সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা আবারও এই বিষয়গুলো সামনে এনেছে। স্থানীয়দের দাবি, দুর্ঘটনা কমাতে পর্যটন ব্যবস্থাপনায় কঠোর নির্দেশনা ও প্রশিক্ষিত গাইড ব্যবস্থার প্রয়োজন।
পরিবারে শোকের মাতম
২৪ বছর বয়সী ইকবাল হাসাইনের বাড়ি ঢাকার ডেমরায়। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ভ্রমণে বের হয়ে প্রাণ হারানোর খবরে পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার সহযাত্রীরা জানান, ইকবাল সাঁতার জানলেও জলপ্রপাতের তীব্র স্রোতে পড়ে ভারসাম্য হারান।
নাফাখুমে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিল—অবহেলা বা অসতর্কতার সামান্য ভুলও প্রকৃতির মাঝে প্রতিনিয়ত বড় ঝুঁকির কারণ হতে পারে। পর্যটনপ্রিয় এই অঞ্চলটিতে নিরাপত্তা জোরদার না করলে ভবিষ্যতেও এমন দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।










সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited