ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আগামী ১৩ নভেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই সংলাপ একাধিক ধাপে আয়োজন করা হবে। ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ আজ রবিবার দুপুরে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের কাছে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সংবাদের শুরুতেই সচিব জানান, “১৩ নভেম্বর থেকেই নিবন্ধিত দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু হবে। ধাপে ধাপে সব দলের সঙ্গে মতবিনিময় হবে।” তিনি আরও বলেন, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টির সঙ্গেও সংলাপের সম্ভাবনা রয়েছে।
নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৫৩; আওয়ামী লীগ আলোচনায় নেই
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫৩টি। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয় এবং দলের নিবন্ধনও স্থগিত থাকে। ফলে ইসির ঘোষিত সংলাপে দলটিকে ডাকছে না কমিশন। সচিবের ভাষায়, “নিবন্ধিত নয় এমন কোনো দলকে সংলাপে আমন্ত্রণ পাঠানো হবে না।”
অন্যদিকে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তপ্ত আলোচনা চলছে কিছু দলকে নিষিদ্ধ বা নিবন্ধন বাতিলের দাবিকে ঘিরে। এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল জাতীয় পার্টি ও ১৪ দল শরিকদেরকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যা দিয়ে ইসির কাছে তাদের নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। এসব দাবির প্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টিকে সংলাপে ডাকবে কি না—তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
সংলাপের উদ্দেশ্য কী?
ইসি সূত্রগুলো বলছে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, নির্বাচনী বিধি-বিধান পর্যালোচনা, মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং প্রযুক্তিগত প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে মতামত সংগ্রহ করাই সংলাপের মূল উদ্দেশ্য।
জ্যেষ্ঠ সচিব বলেন, “নির্বাচন কমিশন চায় নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হোক। সব দলের বক্তব্য শোনা এবং প্রাসঙ্গিক সুপারিশ বিবেচনা করার জন্যই এই সংলাপ।”
সংলাপের আলোচ্যসূচিতে থাকছে—
- নির্বাচনী পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা
- আচরণবিধি এবং প্রয়োগ
- মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া
- ভোটকেন্দ্র ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রস্তুতি
- প্রযুক্তিগত বিষয় যেমন ফলাফল ব্যবস্থাপনা
- নির্বাচন–কালীন প্রশাসনিক সমন্বয়
জাতীয় পার্টিকে আমন্ত্রণ—রাজনৈতিক মহলে বিভক্তি
ইসির নিবন্ধিত দল হিসেবে জাতীয় পার্টির সংলাপে অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মতানৈক্যে রয়েছেন। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন দলটির নিবন্ধন বাতিলের দাবি তুলেছে।
ইসি সচিব অবশ্য বলেছেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো দলের নিবন্ধন বৈধ থাকবে, ততক্ষণ তাকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো থেকে বিরত থাকার কারণ নেই।”
তবে ইসির ভেতরেও অনেকে মনে করছেন—সংলাপ প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে কোন কোন দলকে আমন্ত্রণ জানানো হবে তা খুব সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কারণ সংলাপের আহ্বান কোনো দলের বিরুদ্ধে চলমান বিতর্ককে আরও জটিল করতে পারে।
৫ আগস্টের পটপরিবর্তন এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা
গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দেশের রাজনীতিতে যে নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তা নির্বাচন কমিশনের সংলাপেও প্রভাব ফেলছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থাকায় রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যার ফলে সংলাপের পরিধি এবং ভারসাম্য উভয়ই নতুনভাবে মূল্যায়নের দাবি রাখে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগকে ছাড়াই জাতীয় নির্বাচন আয়োজন একটি জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। তাই সংলাপে কোন কোন দল কতটা গুরুত্ব পাবে, তা নিয়েও বিভিন্ন মহলে কৌতূহল দেখা দিয়েছে।
দলগুলোর সংশয়—সংলাপ কি বাস্তব সমাধান দেবে?
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক কাঠামোর দ্রুত পরিবর্তন, নিবন্ধন বাতিলের দাবি, নিবন্ধিত দলগুলোর সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং মাঠপর্যায়ের অস্থিরতা—সব মিলিয়ে অনেক দলই সংশয়ে রয়েছে যে ইসির এই সংলাপ বাস্তব কোনো ফল দেবে কি না।
গণঅধিকার পরিষদের এক নেতা বলেন, “নিবন্ধিত দলগুলোর সংলাপ অর্থবহ হবে তখনই, যখন ইসি মাঠপর্যায়ে রাজনৈতিক সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে।”
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “আমরা সংলাপে যেতে প্রস্তুত, তবে আমাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক যে অভিযোগগুলো উঠছে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”
সংলাপ নিয়ে ইসির প্রস্তুতি
ইসি জানিয়েছে, সংলাপের আগে প্রতিটি দলের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানো হবে। দলগুলোর মতামত লিখিতভাবেও গ্রহণ করা হবে, যাতে কমিশন সেগুলো পরবর্তীতে নীতি–নির্ধারণে কাজে লাগাতে পারে।
সচিব বলেন, “নির্বাচন কমিশন সকল দলের প্রতি উন্মুক্ত। সংলাপ একটি চলমান প্রক্রিয়া। মতবিরোধ থাকতেই পারে, তবে সংলাপের মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব।”
১৩ নভেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া এই সংলাপ নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য হবে কি না—তা নির্ভর করছে কমিশনের সিদ্ধান্ত, রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ এবং বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে যেসব প্রশ্ন, সংকট এবং বিতর্ক চলমান রয়েছে, এই সংলাপ সেগুলোর কিছুটা হলেও সমাধান দিতে পারে—এমনটাই প্রত্যাশা সাধারণ ভোটারের।











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited