দিনের পর দিন ভয়াবহ যানজটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে হাওড়ার অন্যতম ব্যস্ততম সড়ক আন্দুল রোড। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত—প্রতিদিনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে পণ্যবাহী ট্রাক, ছোট গাড়ি, বাস, এমনকি অ্যাম্বুল্যান্সও। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অফিসযাত্রী, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, এমনকি রোগীবাহী যানও পড়ছে একই দুর্ভোগে।
কোনা এক্সপ্রেসওয়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত এই রাস্তাটি এখন স্থানীয়দের কাছে একপ্রকার আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে। এক বাসিন্দার ভাষায়, “আন্দুল রোড মানেই যানজট, ধুলো, হর্ণ আর অপেক্ষা।”
যানজটের কারণ বহুমুখী
স্থানীয় বাসিন্দা তাপস দাস জানান, সাঁতরাগাছিতে এলিভেটেড করিডর তৈরির কাজ শুরু হওয়ায় মূল সড়কে যান চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছে। ফলে ছোট ও মাঝারি মালবাহী ট্রাকগুলো এখন কোনা এক্সপ্রেসওয়ে এড়িয়ে আন্দুল রোড ধরছে, যার কারণে প্রতিদিনই দীর্ঘ যানজট তৈরি হচ্ছে।
রাস্তাটির এক্সটেনশন বা প্রশস্তকরণের কাজ বহুদিন ধরেই ঝুলে আছে। চুনাভাঁটি, বকুলতলা ও মৌড়িগ্রাম এলাকায় রাস্তাতেই বসে বাজার। ফলে চলাচলের জায়গা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে যত্রতত্র অবৈধ পার্কিং, দোকানপাট ও দখলদারি সমস্যা।
ট্রাক ও ট্যাক্সি পার্কিংয়ের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা না থাকায় চালকেরা রাস্তার ধারে গাড়ি রেখে চলে যান, ফলে সামান্য যানবাহন চলাচলও তীব্র জটের সৃষ্টি করে।
রোগী-সহ অ্যাম্বুল্যান্সও আটকে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা
এই রাস্তার দু’প্রান্তে রয়েছে একটি সুপার স্পেশালিটি ও একটি মাল্টি স্পেশালিটি হাসপাতাল। কলকাতা থেকে কিংবা আন্দুলের দিক থেকে কেউ হাসপাতালে যাওয়ার সময় প্রায়ই যানজটে থেমে যায় অ্যাম্বুল্যান্স। ফলে বহু রোগীকে বিপদের মুখে পড়তে হয়।
স্থানীয় এক বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “জরুরি পরিস্থিতিতে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারছি না সময়মতো। অনেক সময় অ্যাম্বুল্যান্সেই রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এটা কি শহর সভ্যতার লক্ষণ?”
এমন পরিস্থিতিতে অ্যাম্বুল্যান্স চলাচলের জন্য আলাদা লেন বা দ্রুতগামী করিডর তৈরির দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা।
নিয়ম ভেঙে ঢুকছে ভারী ট্রাক
নিয়ম অনুযায়ী আন্দুল রোডে দিনে বড় ট্রাক চলাচল নিষিদ্ধ—শুধু রাত ৯টার পর অনুমতি রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেই নিয়ম কার্যকর হচ্ছে না। দিনদুপুরে অবাধে ঢুকছে বড় বড় ট্রাক ও অয়েল ট্যাঙ্কার।
তাপস দাস বলেন, “বিশেষ করে মৌড়িগ্রাম থেকে অয়েল ট্যাঙ্কার এলে পুরো রাস্তা থমকে যায়। ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখেও কিছু করে না।”
স্থানীয় ব্যবসায়ী সুজিত হালদার বলেন, “রাস্তায় বাজার, তার উপর ট্রাক পার্ক করা থাকে। ফলে রাস্তার অর্ধেকটাই দখল হয়ে যায়। পুলিশ যদি কড়া ব্যবস্থা নিত, কিছুটা হলেও স্বস্তি পাওয়া যেত।”
অফিসযাত্রীদের দৈনন্দিন দুর্ভোগ
প্রতিদিন সকালে অফিসগামী মানুষদের দুর্ভোগ যেন চরমে। দীর্ঘ সময় ট্রাফিকে আটকে থাকা এখন নিত্যদিনের ঘটনা।
অফিসযাত্রী রীতা মুখার্জি বলেন, “প্রতিদিন সকালে সময়মতো বেরোলেও অফিসে পৌঁছতে দেরি হয়। সন্ধ্যায় ফিরতেও একই অবস্থা। সারা কলকাতা ঘুরে এসে এই রাস্তাটুকু পেরোতে দ্বিগুণ সময় লাগে। এ যেন বাড়ির দরজায় এসেও বাড়ি ফিরতে না পারা।”
প্রশাসনের বক্তব্য ও সীমাবদ্ধতা
হাওড়া সিটি পুলিশের এক আধিকারিক জানান, “যানবাহনের চাপ অত্যধিক হওয়ায় মাঝেমধ্যেই জট তৈরি হয়। আমরা অতিরিক্ত ট্র্যাফিক কর্মী মোতায়েন করেছি এবং ভারী ট্রাকগুলোকে বিকল্প রুটে পাঠানোর চেষ্টা চলছে।”
তবে সাধারণ মানুষের দাবি, এগুলো অস্থায়ী পদক্ষেপ। দীর্ঘমেয়াদি সমাধান না আনলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।
স্থায়ী সমাধানের দাবিতে সোচ্চার স্থানীয়রা
স্থানীয়দের দাবি, আন্দুল রোডের সমস্যা সমাধানে তিনটি মূল পদক্ষেপ জরুরি—
১️⃣ রাস্তা প্রশস্তকরণ ও উন্নয়নকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা,
২️⃣ অবৈধ বাজার ও দখলদারি উচ্ছেদ করা,
৩️⃣ ট্রাক চলাচল নিয়ন্ত্রণে কড়া নিয়ম প্রয়োগ করা।
পরিবেশবিদ ও নাগরিক সংগঠনগুলিও এ বিষয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাদের মতে, এই গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি কেবল স্থানীয় নয়, পুরো হাওড়া ও কলকাতা মহানগরীর অর্থনৈতিক গতিশীলতার সঙ্গে জড়িত। ফলে এর অব্যবস্থাপনা দীর্ঘ মেয়াদে পরিবহন ব্যবস্থায় বড় সংকট ডেকে আনবে।
দিনের পর দিন অচল হয়ে পড়া আন্দুল রোডে এখন মানুষের একটাই দাবি—স্বস্তির নিঃশ্বাস। প্রশাসনের কার্যকর হস্তক্ষেপ ছাড়া এই গুরুত্বপূর্ণ সড়ক আবার কবে স্বাভাবিক গতিতে শ্বাস নিতে পারবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited