হুগলির আরামবাগ অঞ্চলের মানুষ আজ রাইস মিলের দূষণে দিশেহারা। দিনের পর দিন মিলের চিমনি থেকে নির্গত পোড়া ছাই আর বর্জ্য আশপাশের গ্রামগুলোকে বিষিয়ে তুলছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিজমি, নষ্ট হচ্ছে ফসল, আর বাতাসে বেড়ে চলেছে ধূলিকণার পরিমাণ। এর প্রভাবে স্থানীয়রা শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, চোখের জ্বালা ও চর্মরোগে ভুগছেন। পরিবেশকর্মীদের দাবি, প্রশাসনকে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, নয়তো এই অঞ্চলের পরিবেশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।
আরামবাগ মহকুমায় বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১২০টি রাইস মিল রয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ৯৫টি রাইস মিল নিয়মিতভাবে চালু রয়েছে। গোটা হুগলি জেলায় মোট রাইস মিলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫০।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অধিকাংশ রাইস মিল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্ধারিত নিয়ম মানছে না। মিলের বয়লার থেকে যে গরম বর্জ্য বের হয়, তা কোনো প্রক্রিয়া ছাড়াই সরাসরি পাশের ধানক্ষেতে ফেলে দেওয়া হয়। এতে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে, ধানগাছ হলুদ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে, এবং ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
‘ছাইয়ে ঢাকা বাড়িঘর, খাবারে পড়ে পোড়া ধুলো’
কোরোলা গ্রামের বাসিন্দা সৌমেন কোলে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
“রাইস মিলের ছাইয়ে আমাদের জীবন অসহ্য হয়ে উঠেছে। বাড়ির ছাদ, দরজা, জানালা সব ছাইয়ে ভরে যায়। দরজা খোলা থাকলে পোড়া ছাই খাবারে পড়ে। চোখে পড়লে জ্বালা করে। ধানগাছের রঙ বদলে যায়, খড় নষ্ট হয়ে যায়।”
জয়রামপুর এলাকার কৃষক অজিত মৈত্র, রাজেশ মৈত্র ও শ্যামল রায় জানান, চাষাবাদ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। জমিতে সারের কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে। ছাই জমে মাটি শক্ত হয়ে যাচ্ছে, পানি ধরে রাখতে পারছে না।
পরিবেশকর্মীদের উদ্বেগ ও আন্দোলন
২০২৩ সালে আরামবাগের জয়রামপুর এলাকার বাসিন্দা তনুশ্রী হাজরা প্রথমবার রাইস মিল দূষণের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করেন রাজ্য পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদে। তাঁর আবেদনের পর তদন্তে নেমে অভিযোগের সত্যতা পান পর্ষদের কর্মকর্তারা।
তদন্তের পর পর্ষদ কড়া নির্দেশিকা জারি করে রাইস মিলগুলোকে ‘ফিল্টার ব্যাগ’ বসানোর নির্দেশ দেয়, যাতে চিমনি থেকে নির্গত ছাই ও ধূলিকণা বাতাসে না ছড়ায়। কিন্তু অভিযোগ, অধিকাংশ রাইস মিল এখনও সেই নির্দেশ মানেনি।
তনুশ্রী বলেন,
“আমি ২০২৩ সালে একার লড়াই শুরু করেছিলাম। হুমকিও পেয়েছি। কিন্তু এখনও অধিকাংশ রাইস মিল ফিল্টার ব্যাগ বসায়নি। দূষণ রোধে প্রশাসনের আরও কঠোর হওয়া দরকার।”
পর্ষদের হুঁশিয়ারি ও রাইস মিল মালিকদের অবস্থান
দূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ পাওয়ার পর সম্প্রতি রাজ্য পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ একাধিক মিলকে নোটিস ধরিয়েছে। পর্ষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরামবাগ মহকুমা রাইস মিল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুনীল ঘোষ সমস্যা স্বীকার করে বলেন,
“বিষয়টি আমরা গুরুত্বসহকারে নিয়েছি। ইতিমধ্যে কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। আমাদের আরও ছয় মাস সময় দেওয়া হোক। এর মধ্যেই উন্নত মানের ফিল্টার ব্যাগ বসানো হবে।”
ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এখন আশার প্রতীক্ষায়
পরিবেশবিদরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে রাইস মিল দূষণের কারণে আরামবাগ অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বায়ু ও মাটির মান দ্রুত অবনতি ঘটছে, যা ভবিষ্যতে মানুষের স্বাস্থ্য ও কৃষি উভয়ের জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে।
স্থানীয়দের দাবি, সরকার ও প্রশাসনকে কেবল নির্দেশনা নয়, বাস্তবায়নের বিষয়েও কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। নয়তো শিগগিরই আরামবাগের এই সবুজ এলাকা পরিণত হবে ছাইয়ে ঢাকা জনপদে।
সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited