দীর্ঘ নয় মাসের অপেক্ষার পর অবশেষে কাল শুক্রবার (১ নভেম্বর) থেকে আবারও খুলে দেওয়া হচ্ছে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন। এদিন থেকে পুনরায় পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু করবে দ্বীপে। প্রথম ধাপে প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এবার কঠোরভাবে মানতে হবে সরকারের জারি করা ১২টি নির্দেশনা।
গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বীপে পর্যটক যাতায়াত বন্ধ ছিল। পর্যটকদের বেপরোয়া ভিড়, অবকাঠামোগত অনিয়ম ও পরিবেশদূষণের কারণে সেন্ট মার্টিনের প্রতিবেশ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। প্রায় নয় মাস বন্ধ থাকার পর এখন দ্বীপের পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
পরিবেশ ফিরছে আগের রূপে
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ছোট এই দ্বীপে ১ হাজার ৭৬ প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে। পর্যটকবিহীন সময়ে সৈকতের শামুক-ঝিনুক, লাল কাঁকড়া ও সামুদ্রিক পাখির সংখ্যা বেড়েছে। মা কাছিমের ডিম পাড়ার জন্যও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) কক্সবাজারের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক বলেন,
“পর্যটক সীমিত করার উদ্যোগের প্রথম নয় মাসেই সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ ও প্রতিবেশের ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। সৈকতজুড়ে এখন লাল কাঁকড়ার চলাচল দেখা যায়, যা আগে পর্যটকদের পদচারণায় হারিয়ে গিয়েছিল।”
এবার আরও কঠোর নজরদারি
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. শাহিদুল আলম জানান, দ্বীপে পরিবেশ রক্ষায় সরকারের নির্দেশনা এবার কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। পর্যটকবাহী জাহাজ এবার কক্সবাজার শহর থেকে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সেন্ট মার্টিনে যাবে। নিরাপত্তার কারণে টেকনাফ রুটে জাহাজ চলাচল আপাতত বন্ধ থাকবে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উপপরিচালক মহিবুল ইসলাম বলেন,
“সেন্ট মার্টিনে যাত্রার জন্য ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টাল থেকে অনলাইন টিকিট সংগ্রহ বাধ্যতামূলক। প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস ও কিউআর কোড থাকবে। কিউআর কোডবিহীন টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে।”
নির্দেশনা অমান্য করলে ব্যবস্থা
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের পরিচালক মো. জমির উদ্দিন বলেন, দ্বীপে ভ্রমণের ক্ষেত্রে কোনো নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
“সেন্ট মার্টিনের নাজুক পরিবেশ রক্ষায় এবার কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। নির্দেশনা বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে তদারকি করবে,” তিনি যোগ করেন।
সরকারের ১২ নির্দেশনার মূল বিষয়গুলো
গত ২২ অক্টোবর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে সেন্ট মার্টিনে ভ্রমণের জন্য নিম্নলিখিত ১২টি নির্দেশনা জারি করা হয়ঃ
১. বিআইডব্লিউটিএ ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া দ্বীপে কোনো নৌযান চলাচল করতে পারবে না।
২. অনলাইনে কিউআর কোডযুক্ত টিকিট ছাড়া ভ্রমণ নিষিদ্ধ।
৩. নভেম্বর মাসে কেবল দিনের বেলায় ভ্রমণ করা যাবে; রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ।
৪. ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে সীমিতভাবে রাত্রিযাপন অনুমোদিত থাকবে।
৫. ফেব্রুয়ারি মাসে পর্যটক যাতায়াত পুরোপুরি বন্ধ থাকবে।
৬. সৈকতে মোটরসাইকেল, সি-বাইক বা অন্য কোনো মোটরচালিত যান চলবে না।
৭. রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি বা বারবিকিউ পার্টি আয়োজন নিষিদ্ধ।
৮. কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা বিক্রি করা যাবে না।
৯. কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজকাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকসহ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করা কঠোরভাবে দণ্ডনীয় অপরাধ।
১০. পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বহন নিষিদ্ধ; প্লাস্টিক বোতল ও মিনিপ্যাক ব্যবহার নিরুৎসাহিত।
১১. প্রত্যেক পর্যটককে নিজস্ব পানির ফ্লাস্ক বহনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
১২. পরিবেশবিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পর্যটনের সমন্বয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেন্ট মার্টিন বাংলাদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অমূল্য সম্পদ। এ দ্বীপের প্রাকৃতিক ভারসাম্য অক্ষুণ্ন রেখে টেকসই পর্যটন নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক বলেন,
“যদি এই ১২টি নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে সেন্ট মার্টিন শুধু পর্যটনের জন্য নয়, পরিবেশ সংরক্ষণেরও একটি সফল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।”











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited