কিশোরগঞ্জের ভৈরবকে জেলা ঘোষণার দাবিতে সোমবার সকাল থেকে উত্তাল হয়ে ওঠে ভৈরব রেলওয়ে জংশন এলাকা। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত চলা অবরোধ কর্মসূচিতে উত্তেজিত বিক্ষোভকারীরা উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেন লক্ষ্য করে ‘শিলাবৃষ্টি’র মতো পাথর নিক্ষেপ করলে কমপক্ষে ২০ জন যাত্রী আহত হন। এ সময় পুরো স্টেশন এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, থমকে যায় ট্রেন চলাচল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা অভিমুখী আন্তঃনগর উপকূল এক্সপ্রেস ভৈরব স্টেশন থেকে ছাড়তে গেলে অবরোধকারীরা ট্রেনের সামনে অবস্থান নেয়। ট্রেনের ইঞ্জিন চলতে শুরু করলে হঠাৎ কয়েকদিক থেকে পাথর নিক্ষেপ শুরু হয়। প্রায় ১০ মিনিট ধরে চলা এই হামলায় ট্রেনের জানালার কাচ ভেঙে যায় এবং অন্তত ২০ যাত্রী আহত হন। আহতদের মধ্যে কয়েকজনকে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও রেলওয়ে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
সাত ট্রেন আটকে, যাত্রীদের চরম ভোগান্তি
অবরোধ কর্মসূচির কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেলপথে মারাত্মক শিডিউল বিপর্যয় ঘটে। ভৈরব স্টেশনে আটকে ছিল নোয়াখালী থেকে আসা উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেন। নরসিংদীর দৌলতকান্দি স্টেশনে আটকে ছিল চট্টগ্রামগামী কনটেইনার ট্রেন, আর নরসিংদী স্টেশনে থেমে যায় কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস। মেথিকান্দায় তিতাস এক্সপ্রেস, খানাবাড়ীতে কর্ণফুলী ট্রেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তালশহরে চট্টলা ট্রেন এবং আজমপুরে কালনী এক্সপ্রেস আটকা পড়ে।
প্রায় দেড় ঘণ্টা রেল চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীদের মধ্যে দেখা দেয় চরম হতাশা ও ক্ষোভ। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, জেলার দাবিতে আন্দোলন করা নাগরিক অধিকার হতে পারে, কিন্তু সাধারণ যাত্রীদের জীবনের ঝুঁকি নেওয়া অমানবিক।
জেলার দাবিতে টান টান উত্তেজনা
জানা গেছে, ১১ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে কিশোরগঞ্জ জেলাকে ময়মনসিংহ বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর পর থেকেই ভৈরববাসীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয় এবং তারা ভৈরবকে পৃথক জেলা ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনে নামে। গত দুই সপ্তাহ ধরে স্থানীয় নাগরিক কমিটি শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি ও মিছিল করেছে।
তবে সোমবারের ঘটনা সেই আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দেয়। ভৈরব বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির, গণঅধিকার পরিষদ, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, ছাত্রসংসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা অবরোধে যোগ দেন।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া নেতৃবৃন্দ ঘোষণা দেন, “আমাদের ১৫ দিনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির পরও সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আগামীকাল (মঙ্গলবার) নৌপথ অবরোধ করা হবে। দাবি না মানলে সড়ক, রেল ও নৌপথ একযোগে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে।”
দোষীদের শনাক্তের আশ্বাস পুলিশের
রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাইদ আহমেদ বলেন, “আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করেছি। পাথর নিক্ষেপের ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে, দোষীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।”
তবে ছাত্রনেতা শাহরিয়ার মোস্তফাই দাবি করেন, “আমাদের আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। কিছু দুষ্কৃতকারী আমাদের কর্মসূচি ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য পাথর নিক্ষেপ করেছে। আমরা নিজেরাই ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করার সিদ্ধান্ত নিই।”
সমালোচনা ও উদ্বেগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে
অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটনাটি নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই লিখেছেন, ভৈরববাসীর দাবির প্রতি সহানুভূতি থাকলেও জনজীবন স্থবির করে আন্দোলন করা যুক্তিযুক্ত নয়। কেউ কেউ প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যা দ্রুত সমাধান করা হয়।
স্টেশন মাস্টারের নীরবতা
এ বিষয়ে ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মোহাম্মদ ইউসুফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান
ভৈরববাসীর জেলা দাবিতে আন্দোলন দীর্ঘদিনের। তবে সোমবারের ঘটনার পর তা নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, জনদাবির প্রতি সরকারের মনোযোগ থাকা জরুরি, তবে সেই দাবিকে কেন্দ্র করে সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এখন প্রত্যাশা—দুই পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক হবে।











সত্যের সন্ধানে আমরা — NRD News Media Limited