রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক পক্ষের গতিবিধি নিয়ে জল্পনা যখন তুঙ্গে, তখন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত হলো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপি প্রতিনিধি দলের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সন্ধ্যা ছয়টার কিছু আগে যমুনায় প্রবেশ করে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমদ প্রতিনিধি দলে ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা ও সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এই বৈঠককে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র আগ্রহ দেখা দেয়। দীর্ঘদিন পর বিএনপি ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মধ্যে এ ধরনের মুখোমুখি সংলাপের আয়োজন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বৈঠকের আগে বিএনপি নেতাদের মন্তব্য
যমুনায় প্রবেশের আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন,
“আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সময় চেয়েছিলাম। তিনি আজ সন্ধ্যা ছয়টায় সময় দিয়েছেন। আমরা দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা এবং আগামীর জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে আলোচনা করব।”
তিনি আরও বলেন, বিএনপি সব সময় চায়—একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হোক, যাতে জনগণ নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার মূল বিষয়: নির্বাচন ও প্রশাসন
বৈঠকের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, প্রশাসনের ভূমিকা, এবং নির্বাচনের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক পরিবেশ—এই তিনটি বিষয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। বিএনপি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের উদ্বেগ ও প্রস্তাবনা তুলে ধরে।
সূত্র মতে, বিএনপি নেতারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে “রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা” ও “দলীয় প্রভাবমুক্ত নির্বাচনী প্রস্তুতি” গ্রহণের আহ্বান জানান।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপি নেতাদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং বলেন, সরকার সব পক্ষের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনী পরিবেশ গড়ে তুলতে চায়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “জনগণের আস্থা অর্জনই নির্বাচনের মূল চাবিকাঠি। এই আস্থা তৈরি করতে সরকার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে।”
বিএনপির অবস্থান: শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চায় দল
বৈঠক শেষে দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি এখনো শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আস্থাশীল। দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, “আমরা সংঘাত চাই না, বরং সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজি।”
তারা মনে করেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এই বৈঠক ভবিষ্যতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংলাপের দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে।
একই সঙ্গে বিএনপি নেতারা প্রশাসনের ভেতরে যারা দলীয় আনুগত্যে প্রভাবিত—তাদের পুনর্বিন্যাসেরও দাবি জানাতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মন্তব্য
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপি নেতাদের এ বৈঠক বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থায় ‘সংলাপের সম্ভাবনা’ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এক বিশ্লেষণে বলেন,
“বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে যে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি তুলছে, তা এখন প্রধান উপদেষ্টার সরকার কেমনভাবে প্রতিফলিত করে—সেটাই মূল প্রশ্ন। তবে এই বৈঠকটি রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।”
পটভূমি: নির্বাচনের আগে সংলাপের তাগিদ
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সব রাজনৈতিক দলকে আলোচনার টেবিলে আসার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। একই সময়ে বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে, তারা কোনো “নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন” চায় না, বরং একটি “নিরপেক্ষ প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন” চায়।
এই প্রেক্ষাপটে আজকের যমুনা বৈঠককে অনেকেই ‘রাজনৈতিক বরফ গলার সূচনা’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন।
উপসংহার
বৈঠক শেষে কোনো পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেনি। তবে উভয় পক্ষের মুখে ছিল আশাবাদের ইঙ্গিত।
রাজনৈতিক মহলে এখন প্রশ্ন—এই আলোচনার ধারাবাহিকতা কি আরও বিস্তৃত সংলাপের দিকে যাবে, নাকি এটি কেবল সৌজন্য সাক্ষাতে সীমিত থাকবে?
যাই হোক, প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপি নেতাদের এই মুখোমুখি সংলাপ দেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতিতে নতুন এক গতি সঞ্চার করেছে—এতে কোনো সন্দেহ নেই।
