কোচবিহার শহরে কালীপুজোর রাতে বাজি পোড়ানোকে কেন্দ্র করে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, শহরের পুলিশ সুপার (SP) দ্যুতিমান ভট্টাচার্য নিজে প্রতিবেশীদের মারধর করেছেন। ঘটনাটি ঘটেছে সোমবার গভীর রাতে শহরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে পুলিশ সুপারের সরকারি বাংলোর সামনে। যদিও SP দ্যুতিমান ভট্টাচার্য অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে পাল্টা দাবি করেছেন, তিনি একাধিকবার প্রতিবেশীদের অনুরোধ করেও শান্তি পাননি, এবং বাজির তাণ্ডবে তাঁর পরিবার ও পোষ্য আতঙ্কে কেঁপে উঠেছিল।
অভিযোগের সূত্রপাত
স্থানীয় আইনজীবী মল্লিকা কার্জি এবং তাঁর স্বামী, স্কুলশিক্ষক পার্থ রায়ের দাবি—পুজোর রাতে তাঁদের বাড়ির কয়েকজন নাবালক পাড়ার অন্য শিশুদের সঙ্গে বাজি ফাটাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় হঠাৎ পুলিশ সুপার নিজে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে নিয়ে তাঁদের বাড়ির সামনে হাজির হন। মল্লিকা কার্জির অভিযোগ, SP কোনও সতর্কতা বা মৌখিক নির্দেশনা না দিয়েই তাঁদের সন্তানসহ কয়েকজন নাবালক এবং উপস্থিত মহিলাদের মারধর করেন।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, “ওঁর যদি সত্যিই সমস্যা থাকত, তাহলে তিনি আগে আমাকে সতর্ক করতে পারতেন। একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে একজন মহিলার গায়ে হাত তোলা কি তাঁর শোভা পায়? সেখানে কোনও মহিলা পুলিশকর্মী ছিলেন না—এটা আরও দুঃখজনক।”
মল্লিকা কার্জি জানিয়েছেন, এই ঘটনার সুবিচার চেয়ে তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও লিখিত অভিযোগ জানাবেন এবং প্রয়োজনে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হবেন। তাঁর স্বামীও একই দাবি করেছেন, “আমাদের বাড়ির বাচ্চারা যদি কিছুটা দোষ করে থাকে, তবুও এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়।”
SP-এর পাল্টা বক্তব্য
অন্যদিকে, পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্য অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “সন্ধ্যা থেকেই ওরা বাজি ফাটাচ্ছিল। আমার নিরাপত্তারক্ষী একাধিকবার গিয়ে অনুরোধ করেছে, কিন্তু রাত একটা পর্যন্ত টানা বাজি চলেছে। শব্দে আমার স্ত্রী ও পোষ্য কুকুরগুলো ভয় পেয়ে কাঁপছিল। আমি নিজে গিয়ে কথা বলেছি, কিন্তু কাউকে মারধর করা হয়নি।”
তিনি আরও দাবি করেন, “আমার আবাসনের সামনেও বাজি ফাটানো হয়েছে। চাইলে আমি ভিডিও ফুটেজ দেখাতে পারব। যে অভিযোগ উঠেছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”
দুই পক্ষের হাতে সিসিটিভি ফুটেজ
ঘটনার তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো—উভয় পক্ষই দাবি করছেন, তাঁদের কাছে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে, যা তাঁদের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করবে। যদিও মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কেউই থানায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করেননি। প্রশাসনও এখন পর্যন্ত কোনও তদন্ত শুরু করেনি, তবে ঘটনাটি ইতিমধ্যে কোচবিহার শহরে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
আইনি ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
রাজ্য প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগ এবছর কালীপুজোর সময় রাত ১০টার পর বাজি ফাটানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। পরিবেশ দূষণ ও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই নির্দেশনা কার্যকর ছিল সমগ্র রাজ্য জুড়ে। সেই নির্দেশ অমান্য করেই নাবালকদের বাজি ফাটানোয় স্থানীয়দের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
একইসঙ্গে, প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনিক শিষ্টাচার নিয়েও। আইন রক্ষার দায়িত্বে থাকা একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যদি নিজে সরাসরি গিয়ে শারীরিকভাবে হস্তক্ষেপ করেন, তবে তা কতটা নীতিসঙ্গত—তা নিয়েও সামাজিক পরিসরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থা
এখনও পর্যন্ত ঘটনার তদন্ত শুরু হয়নি, তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসন বিষয়টি নজরে রেখেছে। আইনজীবী পরিবারের তরফে যদি আদালতে রিট দায়ের করা হয়, তবে ঘটনাটি দ্রুত উচ্চপর্যায়ের তদন্তের আওতায় আসতে পারে।
অন্যদিকে, এলাকাবাসীর মধ্যে বিভক্ত মতামত। একাংশ বলছেন, বাজি পোড়ানো বন্ধের জন্য SP যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছেন; অন্যরা বলছেন, পুলিশের হাতে মহিলার ওপর হামলা কোনওভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
কোচবিহারের এই ঘটনাটি শুধু বাজি পোড়ানো নয়—আইন প্রয়োগ ও নাগরিক দায়িত্ববোধ, দুইয়েরই সীমা কোথায় টানা উচিত, সেই প্রশ্নও নতুন করে সামনে এনেছে। এখন সবার দৃষ্টি সিসিটিভি ফুটেজ ও সম্ভাব্য তদন্তের দিকে—সত্যিই কী ঘটেছিল সেই রাতে, তার উত্তর হয়তো সেখানেই মিলবে।
