বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইটের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে আলোচিত পর্নো-তারকা যুগলকে বান্দরবান থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সোমবার (২০ অক্টোবর) সকালে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান। তিনি জানান, সিআইডির সাইবার মনিটরিং টিম দীর্ঘদিন ধরে তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছিল। পর্যাপ্ত প্রমাণ সংগ্রহের পর বান্দরবানের একটি রিসোর্টে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
আন্তর্জাতিক পর্নো সাইটে সক্রিয় ছিলেন
সিআইডি জানায়, ওই দম্পতি বাংলাদেশে থেকেই ভিডিও ধারণ, সম্পাদনা ও আপলোড করতেন বিদেশি একটি জনপ্রিয় পর্নো ওয়েবসাইটে, যার সার্ভার যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তাদের তৈরি করা কনটেন্ট ওই সাইটে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং ওয়েবসাইটটি বিশ্বের শীর্ষ পর্নো প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে স্থান করে নেয়।
সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, “তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিগ্রাম চ্যানেল ব্যবহার করে তরুণ-তরুণীদের প্রলুব্ধ করতেন এবং অশালীন ভিডিও তৈরিতে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রস্তাব দিতেন। এটি শুধু পর্নোগ্রাফি নয়, একধরনের সংগঠিত অপরাধ।”
বিপুল অর্থ আয় ও মানি ট্রান্সফারের প্রমাণ
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তারা দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে ভিডিও বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছেন। এই অর্থ বিভিন্ন ডিজিটাল ওয়ালেট ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে দেশে পাঠানো হতো। সিআইডি ইতোমধ্যে তাদের আর্থিক লেনদেনের তথ্য অনুসন্ধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU)-এর সহযোগিতা নিয়েছে।
অভিযানে তাদের ব্যবহৃত ক্যামেরা, লাইট, মাইক্রোফোন, ল্যাপটপ ও মোবাইল ডিভাইস জব্দ করা হয়েছে। এসব যন্ত্রে শতাধিক ভিডিও ফাইল ও কনটেন্ট পাওয়া গেছে, যা পর্নোগ্রাফি আইনের আওতায় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে কঠোর শাস্তির বিধান
বাংলাদেশে ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২’ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি তৈরি, প্রকাশ, বিতরণ বা প্রচার করলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে। আইনটি আরও বলে, কেউ যদি পর্নোগ্রাফি ব্যবসার নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে বা এতে অন্যদের উৎসাহিত করে, তবে তা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের পর্যায়েও পড়তে পারে।
সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. নাজমুল হুদা বলেন, “এ ধরনের কনটেন্ট শুধুমাত্র নৈতিক অবক্ষয় নয়; এটি সাইবার অপরাধ, অর্থ পাচার ও মানসিক শোষণের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশে বসে আন্তর্জাতিক পর্নো কনটেন্ট তৈরি করা একটি নতুন ধরণের অপরাধ প্রবণতা।”
দেশীয় নেটওয়ার্কের সূত্র মিলছে
সিআইডির তদন্তে জানা গেছে, এই দম্পতির সঙ্গে আরও অন্তত ৮-১০ জন কনটেন্ট নির্মাতা যুক্ত ছিলেন, যারা গোপনে দেশের বিভিন্ন শহরে ভিডিও ধারণে সহায়তা করতেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘মডেলিং’ বা ‘ভিডিও প্রজেক্ট’-এর নাম করে তরুণীদের প্রলুব্ধ করতেন।
এ বিষয়ে সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ধারণা করছি, এটি একটি সুসংগঠিত নেটওয়ার্ক। তাদের গ্রেফতারের পর আরও কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।”
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দম্পতির কনটেন্ট নিয়ে তীব্র আলোচনার সৃষ্টি হয়। অনেক ব্যবহারকারী বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে অনলাইন অভিযানের দাবি জানান।
এরপরই একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘দ্য ডিসেন্ট’ নামের অনলাইন সংবাদমাধ্যম। সেই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক পর্নো সাইট পরিচালনার চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সিআইডি তদন্ত শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত বান্দরবান থেকে দম্পতিটিকে গ্রেফতার করে।
তদন্ত চলছে
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান জানান, “প্রাথমিকভাবে আমরা তাদের বিদেশি ওয়েবসাইটের সঙ্গে সংযোগের প্রমাণ পেয়েছি। এখন তদন্ত চলছে—তাদের সহযোগীরা কারা, অর্থের উৎস কোথায় এবং কীভাবে বিদেশে স্থানান্তর করা হতো তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশে বসে কেউ পর্নোগ্রাফি ব্যবসা চালাতে পারবে না। ইন্টারনেট যতই উন্মুক্ত হোক, এই অপরাধ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নয়, আইন প্রয়োগ করেই রোধ করা হবে।”
সমাজে সতর্কবার্তা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তির অপব্যবহার করে যৌনতা ও অশ্লীলতার ব্যবসা তরুণ প্রজন্মের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠছে। অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই বিপদ মোকাবিলা সম্ভব নয়।
