পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় এক পরিত্যক্ত ভবন থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ছাত্রদল নেতা ও পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়েদ হোসাইনের (২৪) রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
রোববার (১৯ অক্টোবর) সন্ধ্যার দিকে পানির পাম্প গলির একটি পরিত্যক্ত ভবনে এই লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত জুবায়েদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন।
টিউশনিতে যাওয়ার পথে নিখোঁজ, সন্ধ্যায় লাশ উদ্ধার
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে জুবায়েদ টিউশনিতে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে স্থানীয় কয়েকজন যুবক পানির পাম্প গলির একটি পরিত্যক্ত ভবনের ভেতর রক্তাক্ত অবস্থায় তার দেহ দেখতে পান এবং সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে খবর দেন।
বংশাল থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।
‘ছুরিকাঘাতে মৃত্যু’ — পুলিশের প্রাথমিক ধারণা
বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, “জুবায়েদ হোসাইন ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তার শরীরের বুকে ও পিঠে ধারালো অস্ত্রের একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ঘটনাস্থলটি তার টিউশনের বাসার কাছেই।”
তিনি আরও বলেন, “এখনো হত্যার মোটিভ নিশ্চিত নয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হতে পারে। আমরা আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা করছি এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্তে তদন্ত চলছে।”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তাজাম্মুল হক বলেন, “ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। পুলিশকে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিহত শিক্ষার্থীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। আমরা ন্যায়বিচার নিশ্চিতের জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব।”
সহপাঠীদের ক্ষোভ ও শোক
জুবায়েদের সহপাঠী ও বন্ধুদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী মিজান বলেন, “জুবায়েদ ছিল খুবই শান্ত স্বভাবের ছেলে। রাজনীতি করত, কিন্তু কারও সঙ্গে কোনো শত্রুতা ছিল না। কে বা কারা তাকে হত্যা করল, আমরা বুঝতে পারছি না।”
অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, “ও টিউশন করে নিজের খরচ চালাত। এমন পরিশ্রমী একটা ছেলেকে এভাবে হারাতে হবে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন।”
ছাত্রদলের দাবি: পরিকল্পিত হত্যা
জবি ছাত্রদলের একাধিক নেতাকর্মী দাবি করেছেন, জুবায়েদকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাঈদ আহমেদ বলেন, “এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে আমাদের ধারণা।”
তিনি দ্রুত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
পুলিশের তদন্ত চলছে
বংশাল থানার এক তদন্ত কর্মকর্তা জানান, “লাশ উদ্ধারের পর ঘটনাস্থলটি আমরা ঘিরে রেখেছি। সেখানে রক্তের ছাপ, একটি ব্যবহৃত রুমাল ও ভাঙা মোবাইল ফোন পাওয়া গেছে। আমরা ফরেনসিক টিমকে ডেকেছি।”
তিনি আরও জানান, “এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও নিহতের সর্বশেষ কললিস্ট সংগ্রহের কাজ চলছে। এতে জড়িতদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।”
পরিবারের আহাজারি
জুবায়েদের বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। তিনি ঢাকায় থেকে পড়াশোনা ও টিউশন করতেন। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে পরিবার ঢাকায় ছুটে আসে। জুবায়েদের ছোট ভাই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার ভাই শুধু স্বপ্ন দেখত—একটা ভালো চাকরি করবে, পরিবারকে সুখে রাখবে। কিন্তু কেউ তাকে নির্মমভাবে মেরে ফেলল।”
সমাজে তোলপাড়
এই হত্যাকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দার ঝড় উঠেছে। অনেকেই নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ তুলেছেন পুরান ঢাকার অলিগলিতে।
স্থানীয়রা বলছেন, পরিত্যক্ত ভবনটি দীর্ঘদিন ধরেই অপরাধীদের আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। এ ঘটনার পর এলাকাবাসী ভবনটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণের দাবি জানিয়েছেন।
