বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় এক যুবক ক্ষোভের বশে মাইক ভাড়া করে গ্রামজুড়ে ঘুরে এলাকাবাসীকে গালাগাল করেছেন। এমনই এক ব্যতিক্রমী ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ পানান গ্রামে।
ঘটনাটি ঘটেছে শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) দুপুরে। ওই যুবকের নাম রাব্বি, যিনি দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।
ঘটনার পর তিনি মাইক হাতে নিয়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশের ভিডিও রেকর্ড করে তা নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করেন। মুহূর্তেই ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়, ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
অর্থ না থাকায় স্বপ্নভঙ্গ
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাব্বি বহুদিন ধরে প্রবাসে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সম্প্রতি সৌদি আরবে একটি ভিসা পাওয়ার পরও পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে তার যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তিনি জানিয়েছেন, মাত্র এক লাখ টাকা না থাকায় তার ভিসা ও মেডিকেল সনদের মেয়াদ (৩০ অক্টোবর পর্যন্ত) শেষ হতে চলেছে।
এই স্বপ্নপূরণের আশায় তিনি স্থানীয় বিভিন্ন এনজিও, সমিতি ও সমাজের বিত্তবানদের কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু কারও কাছ থেকে সহযোগিতা না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েন।
মাইকে ক্ষোভ প্রকাশ
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, শুক্রবার দুপুরের দিকে রাব্বি প্রায় ৫০০ টাকা খরচ করে একটি মাইক ভাড়া নেন। এরপর গ্রামে ঘুরে ঘুরে মাইকে বলেন, “আমি অনেককে বলেছি, একটু সাহায্য করুন, যেন আমি বিদেশ যেতে পারি। কেউ এগিয়ে আসেনি। সবাই শুধু কথা দিয়েছে, সাহায্য করেনি। আজকে আমি সবার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছি।”
তার এই বক্তব্যে কখনো রাগ, কখনো কান্না মিশে ছিল। গ্রামের লোকজন প্রথমে ঘটনাটি মজার মনে করলেও পরে তা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
‘আমি খারাপ ভাষা ব্যবহার করেছি, তবুও শুনুন আমার কথা’
পরে রাব্বি নিজেই তার গালাগালের ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেন। ভিডিওর ক্যাপশনে তিনি লেখেন,
“প্রথমেই ক্ষমা চাইছি। আমি অনেক খারাপ ভাষায় গালাগাল করেছি। আমি কেন এমন করেছি, সেটাই সবাইকে জানাতে চাই। আমি হতাশ, অসহায়, তাই এমনটা করেছি।”
ভিডিওতে তিনি বলেন, “তিন-চার মাস ধরে চেষ্টা করছি। ভিসা হাতে পেয়েছি, মেডিকেল করেছি, সব কিছু রেডি। শুধু এক লাখ টাকা না থাকায় এখন সব শেষ হতে যাচ্ছে। ব্যাংকে গেছি, এনজিওতে গেছি— কেউ টাকা দেয়নি। আমি এখন কাকে বলব?”
ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর স্থানীয়ভাবে এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। অনেকে তার কষ্টের প্রতি সহানুভূতি দেখালেও, কেউ কেউ এমন আচরণকে ‘অতিরঞ্জিত’ ও ‘অশোভন’ বলে সমালোচনা করেছেন।
‘পরিবারের দায়ে হতাশা বেড়েছে’
রাব্বি স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, তিনি বিবাহিত ও এক সন্তানের বাবা। সংসারের দায়িত্ব সামলে অটোরিকশা চালানোর পাশাপাশি বিকাশ এজেন্টের কাজ করেন। পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস হওয়ায় বিদেশে গিয়ে ভালো কিছু করার স্বপ্নই ছিল তার।
তিনি বলেন, “বিদেশে গেলে একটু ভালোভাবে সংসার চালাতে পারতাম। বাচ্চার জন্য কিছু করতে পারতাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব শেষ।”
মানসিক চাপ ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
স্থানীয় সমাজকর্মীরা বলছেন, এমন ঘটনা তরুণ সমাজের হতাশার এক প্রতিচ্ছবি। আর্থিক অনটন ও সামাজিক অবহেলায় অনেক তরুণ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন।
স্থানীয় সমাজসেবক কামরুল ইসলাম বলেন, “রাব্বির আচরণ নিঃসন্দেহে ভুল, কিন্তু এই ঘটনার পেছনে রয়েছে তার মানসিক চাপ ও আর্থিক দুরবস্থা। আমরা এমন তরুণদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।”
সমাজে আলোচনার ঝড়
ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেটিজেনদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ রাব্বির হতাশাকে সহানুভূতির চোখে দেখেছেন, আবার কেউ বলছেন— রাগ বা ক্ষোভ প্রকাশের এমন অশোভন পদ্ধতি সমাজে বিভ্রান্তি তৈরি করে।
তবে একটি বিষয় স্পষ্ট— বিদেশগামী শ্রমিকদের অর্থনৈতিক সংকট, ঋণ জোগাড়ের ব্যর্থতা ও সামাজিক উদাসীনতা যে অনেক সময় মানসিক বিপর্যয়ে রূপ নেয়, এই ঘটনাটি তারই বাস্তব উদাহরণ।
