ওমানের দুখুম সিদ্দা এলাকায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার সাত প্রবাসীর মরদেহ শনিবার রাতে দেশে পৌঁছেছে। রাত ৯টা ২০ মিনিটে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানের কার্গো বিভাগ থেকে স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
প্রবাসজীবনের কঠোর পরিশ্রম আর আশায় ভরা দিনগুলো শেষ হলো একসঙ্গে সাত তরুণের লাশ হয়ে ফিরে আসায়। বিমানবন্দরের মরদেহ গ্রহণকেন্দ্রে হৃদয়বিদারক দৃশ্য—বাবা, মা, ভাই, সন্তান ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পুরো পরিবেশ।
নিহতরা হলেন—সারিকাইতের আমিন মাঝি, মো. আরজু, মো. রকি, সাহাব উদ্দিন, মো. বাবলু, মাইটভাঙার মো. জুয়েল এবং রহমতপুরের মো. রনি। সাতজনই সন্দ্বীপ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বাসিন্দা।
দুর্ঘটনা ওমানের দুখুম সিদ্দা এলাকায়
ওমানের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানা যায়, সাগরে মাছ শিকারের কাজ শেষে ফেরার পথে তারা একটি মাইক্রোবাসে করে যাচ্ছিলেন। পথে দুখুম সিদ্দা এলাকায় তাদের গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান সাতজনই। আহত হন আরও দুই বাংলাদেশি শ্রমিক, যাদের স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে স্থানীয় পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে বলে ওমানের বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে।
‘ছেলে মাছ ধরত, এখন কেবল কফিনে ফিরল’
নিহত সাহাব উদ্দিনের বাবা মো. সিদ্দিক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন,
“আমার ছেলে তিন বছর ধরে ওমানে মাছ ধরার বোটে কাজ করত। কয়েক দিন সাগরে থাকার পর সকালে বাসায় ফিরছিল। পথে গাড়ি উল্টে মারা যায়। এখন আর কিছুই নেই, কেবল কফিনে ফিরেছে আমার সাহাব।”
একইভাবে নিহত আমিন মাঝির ভাই জানান, “আমিন তিন মাস আগে ছুটি কাটিয়ে ওমানে ফিরে গিয়েছিল। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরল।”
প্রতিটি পরিবারেই চলছে আহাজারি ও নিস্তব্ধতা। সন্দ্বীপের সারিকাইত, মাইটভাঙা ও রহমতপুর গ্রামজুড়ে এখন শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
বিমানবন্দরে শোক, স্বজনদের আহাজারি
শনিবার রাত ৯টা ২০ মিনিটে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কার্গো বিমানে করে আসে মরদেহগুলো। বিমানবন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল বলেন,
“ওমান থেকে পাঠানো সাতটি মরদেহ যথাযথ প্রক্রিয়ায় স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।”
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করা হয়েছে। প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানান, “প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে।”
প্রবাসজীবনের ঝুঁকি ও বাস্তবতা
বাংলাদেশি শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য অংশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মরত, যার মধ্যে ওমান অন্যতম। ওমানের উপকূলীয় অঞ্চলে হাজারো বাংলাদেশি কাজ করেন মাছ ধরা, নির্মাণ ও সার্ভিস সেক্টরে। তাদের অধিকাংশই নিম্নআয়ের প্রবাসী, যারা পরিবারের জীবিকা নির্বাহে প্রতিনিয়ত জীবনঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন।
সন্দ্বীপ উপজেলার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এই সাতজনই ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কেউ ঘর তুলতে, কেউ সন্তানদের পড়াশোনার খরচ যোগাতে বিদেশ গিয়েছিলেন। এখন তাদের পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে গেল।
সন্দ্বীপ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এক শোকবার্তায় বলেছেন,
“এই সাত প্রবাসীর মৃত্যু শুধু সাতটি পরিবারের নয়, পুরো সন্দ্বীপবাসীর শোক। আমরা সরকারের কাছে তাদের পরিবারের পুনর্বাসনের দাবি জানাই।”
মরদেহ নিয়ে গ্রামের পথে শেষযাত্রা
বিমানবন্দর থেকে মরদেহগুলো রাতেই সন্দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল নাগাদ নিজ নিজ গ্রামের মসজিদে জানাজা শেষে তাদের দাফন সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
শাহ আমানত বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ এক স্বজনের কণ্ঠে উঠে আসে বাংলাদেশের হাজারো প্রবাসীর একই গল্প:
“ওরা রেমিট্যান্স পাঠায়, দেশের অর্থনীতি চালায়। কিন্তু নিজেরাই ফিরে আসে কফিনে। আমরা শুধু লাশ দেখি, স্বপ্ন দেখি না।”
ওমান পুলিশ তদন্তে, বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তার আশ্বাস
ওমানের দুখুম পুলিশ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, চালক ঘুমিয়ে পড়ায় গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারায়।
ওমানের বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, নিহতদের মরদেহ দেশে পাঠানো ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সম্পন্ন করতে তারা সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে এবং পরিবারের পাশে থাকবে।
নিহতদের নাম:
আমিন মাঝি (সারিকাইত), মো. আরজু (সারিকাইত), মো. রকি (সারিকাইত), সাহাব উদ্দিন (সারিকাইত), মো. বাবলু (সারিকাইত), মো. জুয়েল (মাইটভাঙা), মো. রনি (রহমতপুর)।
