বর্ষা বিদায় নিতেই মশাবাহিত রোগের প্রকোপ ফের বাড়তে শুরু করেছে। ঠিক এমন সময় হুগলি জেলার পোলবা থানার জারুরা গ্রামে হানা দিল চিকুনগুনিয়া ভাইরাস। ইতিমধ্যেই এই গ্রামের অন্তত ৩০ জন বাসিন্দার শরীরে চিকুনগুনিয়ার জীবাণু শনাক্ত হয়েছে, যা এলাকায় ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
গত বছর মালদহ জেলার হবিবপুর ব্লকের কলাইবাড়ি গ্রামে অক্টোবর মাসেই একইভাবে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। এ বছরও একই মাসে হুগলির গ্রামীণ এলাকায় রোগটির উপস্থিতি বিশেষভাবে চিন্তিত করেছে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে।
প্রশাসনের তৎপরতা ও স্বাস্থ্য দপ্তরের নজরদারি
ঘটনার পর থেকেই জেলা স্বাস্থ্য দপ্তর ও প্রশাসন তৎপর হয়ে উঠেছে। পোলবা গ্রামীণ হাসপাতালের উদ্যোগে শুক্রবার জারুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বিশেষ মেডিক্যাল ক্যাম্প আয়োজন করা হয়। সেখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রক্ত সংগ্রহ এবং সচেতনতা কর্মসূচি চালানো হয়। একই সঙ্গে আক্রান্ত এলাকাগুলোয় মাইকিং ও ঘরে ঘরে প্রচার শুরু হয়েছে।
পোলবার বিএমওএইচ (Block Medical Officer of Health) ডা. কৌশিক মণ্ডল জানান, “গত ১০ অক্টোবর আমাদের নজরে আসে যে জারুরা গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন এবং শরীরে ব্যথা অনুভব করছেন। প্রাথমিকভাবে তাঁদের ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গি পরীক্ষা করা হয়, কিন্তু ফলাফল নেগেটিভ আসে। পরে পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া যায় যে তাঁরা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত।”
স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের উপস্থিতি
শনিবার সকালে আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শনে যান চুঁচুড়ার বিধায়ক অসিত মজুমদার, তাঁর সঙ্গে ছিলেন পোলবার বিডিও জগদীশ বাড়ুই, জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক ডা. মৃগাঙ্গ মৌলি কর, এবং সুগন্ধা পঞ্চায়েতের প্রধান সুব্রত ঘোষ। তাঁরা আক্রান্ত পরিবারগুলোর খোঁজখবর নেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
এসময় স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে মশারি বিতরণ করা হয় এবং বাসিন্দাদের বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। বিধায়ক অসিত মজুমদার বলেন, “গ্রামাঞ্চলে সচেতনতার অভাবে এমন সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসনের পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব নিজের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা।”
চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ ও প্রতিকার
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, চিকুনগুনিয়া মূলত এডিস প্রজাতির মশার কামড়ে ছড়ায়, যা ডেঙ্গির মতোই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে যদি সময়মতো চিকিৎসা না হয়। রোগটির প্রধান উপসর্গ হলো — হঠাৎ জ্বর, হাত-পায়ে ও জোড়ায় ব্যথা, শরীরে র্যাশ, দুর্বলতা এবং কখনও চোখে জ্বালা।
ডা. মৃগাঙ্গ মৌলি কর বলেন, “ডেঙ্গির মতো প্রাণঘাতী না হলেও চিকুনগুনিয়া রোগীরা অনেক সময় এমন যন্ত্রণায় ভোগেন যে তাঁরা হাঁটাচলা পর্যন্ত করতে পারেন না। তাই প্রাথমিক উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।”
চিকিৎসকরা আরও জানান, এই ভাইরাসে সাধারণত মৃত্যু ঘটে না, তবে বয়স্ক বা দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা জটিলতা তৈরি করতে পারে।
প্রতিরোধই একমাত্র উপায়
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ বজায় রাখা এবং মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা। বাড়ির চারপাশে পানি জমতে না দেওয়া, ফুলদানি বা টবের পানি নিয়মিত পরিবর্তন করা, এবং ঘুমের সময় মশারি ব্যবহার করাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক ডা. মৃগাঙ্গ মৌলি কর বলেন, “ডেঙ্গি বা চিকুনগুনিয়া – দুই-ই প্রতিরোধযোগ্য রোগ। মানুষ একটু সচেতন হলেই এই বিপদের হাত থেকে বাঁচা সম্ভব।”
স্থানীয়দের উদ্বেগ ও আশা
এলাকাবাসী জানাচ্ছেন, গত কয়েক সপ্তাহে হঠাৎ করেই জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে। বহু পরিবার এখন ভয় পাচ্ছে রোগটি আরও ছড়িয়ে পড়বে কি না। তবে স্বাস্থ্য দপ্তর ও প্রশাসনের দ্রুত উদ্যোগে তাঁদের মধ্যে কিছুটা আশার আলো দেখা দিয়েছে।
এখন পুরো এলাকা কড়া নজরদারিতে, নিয়মিত ফগিং ও লার্ভা ধ্বংস অভিযান চলছে। প্রশাসন আশাবাদী, দ্রুত এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
